সুরা বুরুজ পবিত্র কোরআনের ৮৫তম সুরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এর ১ রুকু, ২২ আয়াত। বুরুজ মানে রাশিচক্র।
এই সুরার মূল বাণী এই যে যারা অবিশ্বাসী, যারা বিশ্বাসীদের নির্যাতন করে, তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত। আর যারা বিশ্বাস করে সৎকর্ম করে, তারা থাকবে জান্নাতে। মর্যাদাপূর্ণ কোরআন রয়েছে লওহে মাহফুজ বা সংরক্ষিত ফলকে।
সুরা বুরুজের সারকথা
এই সুরায় বলা হয়েছে আসহাবুল উখদুদের কিসসা। একটি জাতি তাদের শত দুর্বলতা সত্ত্বেও বাদশাহর বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মে অবিচল ছিল। বাদশাহ তাদের সবাইকে হত্যা করে। আর তারা সবাই ইমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে তারা আরোহণ করেন সাফল্যের স্বপ্নচূড়ায়। যারা আল্লাহর ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে মানুষের ওপর জুলুম চালায় তাদের রয়েছে শাস্তি।
সুরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে ‘শপথ রাশিচক্রবিশিষ্ট আকাশের।’ দুর্গ বিশিষ্ট আকাশের শপথ করে বোঝানো হয়েছে যে, এটি খুব সুরক্ষিত। তাতে ফেরেশতা বিদ্যমান। দুর্গে যেমন নিরাপত্তা প্রহরীরা সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে, তেমনি আকাশেও ব্যবস্থা রয়েছে। তা–ই আল্লাহর বিভিন্ন শক্তি—বায়ু, পানি, শব্দ, ভূমিকম্প—এবং ঐশী উপাদানের—যেমন আবাবিল পাখি, ফেরেশতা ইত্যাদির—অনন্য উৎস।
এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘শপথ প্রতিশ্রুত দিনের। শপথ সাক্ষ্যদাতার ও যার সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেওয়া হয় তার।’ শপধ করা হয়েছে বিচারের দিনের। আরও শপথ করা হয়েছে যে দেখে এবং যা দেখা হয় তার। বিচারের দিন সব সাক্ষী ও সাক্ষ্য পেশ করা হবে এবং সেদিন কোনো অবিচার হবে না।
চতুর্থ ও পঞ্চম আয়াতে আছে ‘অভিশপ্ত হয়েছিল। (অগ্নিকুণ্ডের) লোকেরা, ওরা ইন্ধন সংযোগ করে।’ মূলত তারা গর্তওয়ালারা বিশ্বাসীদের মারার জন্যই আগুনের গর্ত করেছিল। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন মারা পড়েছে গর্তওয়ালারাই। আখিরাতে তাদের জন্য আগুনের জ্বালানি বিশিষ্ট গর্ত জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। এ ঘটনার সাক্ষী বিচারের দিন, যা দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে। বিশ্বাসীদের জন্য গর্ত খোঁড়া আর নিজেরা জাহান্নামের গর্তে পড়া—এই দুই কারণেই তাদের গর্তওয়ালা বলা হয়েছে।
অভিশপ্ত হয়েছিল। (অগ্নিকুণ্ডের) লোকেরা, ওরা ইন্ধন সংযোগ করে, তার (অগ্নিকুণ্ডের) পাশে বসে থাকত এবং দেখত বিশ্বাসীদের ওপর তারা যে অত্যাচার করত।’ (সুরা বুরুজ, আয়াত: ৪-৭)
আল্লাহ জ্বলেপুড়ে মরার বীভৎস দৃশ্য বর্ণনা না করে ইঙ্গিত দিয়ে অল্প ভাষায় সে অবস্থা বর্ণনা করেছেন।
অষ্টম ও নবম আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘ওরা তাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিল শুধু এই কারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরম শক্তিমান, পরম প্রশংসনীয় আল্লাহ্র ওপর, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আর আল্লাহ্ তো সর্ব বিষয়ে দ্রষ্টা।’
অধিকার–বঞ্চিত বা অত্যাচারিত হয়ে গর্তওয়ালারা বিশ্বাসীদের সঙ্গে শত্রুতা করেনি, বিশ্বাসীরা আল্লাহর ওপর ইমান এনেছিল বলেই তাদের সব শত্রুতা। এখানে আল্লাহ বিশ্বাসীদের একা ভাবতে নিষেধ করে বলেছেন যে মহাপরাক্রমশালী, প্রশংসিত, আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী এবং সর্বদ্রষ্টা আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন।
দশম আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা বিশ্বাসী নরনারীকে নির্যাতন করেছে ও তারপর তওবা করেনি, তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আর দহন যন্ত্রণা।
১১ তম আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিচে নদী বইবে। এ-ই মহাসাফল্য।’ এই আয়াতটিই সবচেয়ে শান্তিদায়ক।
১২ তম আয়াতে আছে, ‘তোমার প্রতিপালকের মার বড়ই কঠিন।’ অপরাধ করার পর অল্পতেই পার পেয়ে যাওয়া যাবে এমন মনে করা ঠিক হবে না। নির্দোষ মানুষদের কষ্ট দেওয়ার শাস্তি কত ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝানোর জন্য আল্লাহ তার রব নামটি ব্যবহার করেছেন।
১৩ থেকে ১৬ আয়াতে আছে ‘তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন ও পুনরাবর্তন ঘটান। আর তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়; সম্মানিত আরশের অধিকারী। তিনি যা ইচ্ছা তা করেন।’ আল্লাহ দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার অন্যতম কারণ হলো ন্যায়বিচার। তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়; সঙ্গে সঙ্গে সম্মানিত আরশের মালিকও বটে। তাই তিনি অত্যাচারিত বিশ্বাসীদের আবার সৃষ্টি করে ক্ষমা করবেন; সঙ্গে সঙ্গে যারা অপরাধ করে তাওবা করে তাদেরও এবং আরশের মালিক হিসাবে অত্যাচারীদের যারা তাওবা করেনি বিচার করে যা চান তাই করবেন।
১৭ ও ১৮ আয়াতে আছে, ‘তোমার কাছে কি পৌঁছেছে ফেরাউন ও সামুদের সৈন্যবাহিনীর (কথা)?’ আল্লাহর শক্তি ও তার বাহিনীর বিপরীতে ওই সব সেনাদলের কি করুন পরিণতিই না হয়েছিল।
২০ আয়াতে আছে, ‘আর আল্লাহ পেছন থেকে ওদেরকে ঘিরে রাখেন।’ অত্যাচারীরা মনে করে তারা বিশ্বাসীদের বিপরীতে শক্তিমান কিন্তু মূলত আল্লাহ তাদের সবদিক থেকে সব সময়েই ঘেরাও করে রাখেন। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার বলয়ের মধ্যেই তারা থাকে।
২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে ‘না, এ তো সম্মানিত কোরান, যা রয়েছে লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ফলকে।’ বলা হয়েছে আল কোরআনের কথা। কোরআনের লেখা অপরিবর্তনীয়। এর বিলুপ্তি হবে না, এর অবমাননা করা সম্ভব নয়।
সূত্র: কোরান শরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশ