মেলার সময় হলো। কতিপয় কোরাইশ এলেন আল-ওয়ালিদ ইবনে আল-মুগিরার কাছে। আল-ওয়ালিদ জ্ঞানী-গুণী লোক। তাঁদের তিনি বললেন, ‘মেলার সময় হয়ে এল। আরবরা এখানে আসবে। ওরা সবাই নিশ্চয়ই এই লোকের কথা এরই মধ্যে জেনে গেছে। তাদের কাছে কী বলবে তোমরা সবাই মিলে ঠিক করে নাও, যাতে এক একজন এক এক কথা না বলে। তাহলে কেউ কারও কথা বিশ্বাস করবে না।’
তারা বলল, ‘আপনিই বলুন ওকে কী বলা যায়।’
তিনি বললেন, ‘না, তোমরা বলো, আমি শুনে যাই।’
ওরা বলল, ‘ওটা একটা কাহিনি।’
তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্র কসম, ও কাহিনি নয়। ও তো দুর্বোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে না, ছন্দ মিলিয়ে কথা বলে না।’
‘তাহলে ওকে ভূতে ধরেছে।’
‘না, তা-ও নয়। ভূতে ধরা লোক আমরা দেখেছি। ওর গলায় বিকৃতি নেই, শরীরে টান নেই, ফিসফিস করে সে কথাও বলে না।’
ওরা বলল, ‘তাহলে ও কবি একটা।’
‘না, কবি নয়। কারণ, কবিতার সব ধরনধারন ছন্দটন্দ আমাদের জানা আছে।’
‘তাহলে ও জাদুকর।’
‘না, আমরা জাদুকরের জাদু সব দেখেছি। ও তো কাউকে থুতু দেয় না, কোথাও কোনো বান মারে না।’
তারা প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কী বলব, অ্যাঁ, আবু আবদু শামস?’
তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্র নামে বলছি, ওর কথা খুব মিষ্টি, ওর শিকড় যেন খেজুরগাছের, তার শাখায় শাখায় ফল। যা যা তোমরা বললে, সব যে মিথ্যে, তা সহজেই ধরা পড়ে যাবে। তবে এই যে বললে ও জাদুকর, এটা বরং সত্যের কাছাকাছি। জাদুকর, এমন এক বাণী নিয়ে এসেছে, যা বাপের কাছ থেকে, ভাইয়ের কাছ থেকে, স্ত্রীর কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে মানুষকে কেড়ে নিয়ে আলাদা করে দেয়।’
এ কথা শুনে ওরা সব চলে গেল। যেসব পথে মেলার লোক আসবে, সেসব পথের মাথায় ওরা বসতে শুরু করল।
তারপর একবার পিছিয়ে গিয়ে আবার সদম্ভে ফিরে এল, বলল, ‘এ তো সেই পুরোনো জাদু ভিন্ন আর কিছু নয়।’
তাঁর সঙ্গে অন্য যারা ছিল, যারা রাসুলে করিম (সা.) এবং আল্লাহ্র কাছ থেকে আসা ওহির বর্ণনা করতে গিয়ে একটা জঘন্য শব্দ ব্যবহার করেছিল, আল্লাহ্ তাদের ওপরও আয়াত নাজিল করেছেন। বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছিলাম, তাদের কথা বলে, যারা অনেক দলে বিভক্ত, যারা কোরআনকে বিভিন্ন ভাগে করে ফেলেছে। তোমার প্রভুর শপথ, আমি তাদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে প্রশ্ন করব।’
ওরা যাকে পেল তার কাছেই রাসুলে করিম (সা.) সম্পর্কে সেই অপপ্রচার করল। যারা মেলায় এসেছিল সবাই রাসুলে করিমের (সা.) খবর তাদের বর্ণনা অনুযায়ী জেনে গেল। পুরো আরবে তাঁকে নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেল। আবু তালিব শঙ্কিত হলেন, সমস্ত লোক তাঁর আর তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চলে যাবে, তিনি ঠেকাতে পারবেন না তাদের। তিনি তখন একটি কবিতা রচনা করলেন। এই গাথার মাধ্যমে তিনি মক্কার হারাম শরিফের শরণার্থী হলেন, ওখানে তাঁর পদমর্যাদার দোহাই দিয়ে। সে কবিতায় তার দেশের সমস্ত বিখ্যাত মনীষীর প্রশস্তি গাইলেন এবং অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাদের ও অন্য সবাইকে বলে দিলেন তিনি রাসুলকে ত্যাগ করবেন না, কোনো কিছুর বিনিময়ে তাকে কোনো বিপদের মুখে যেতে দেবেন না, তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি জীবন দিতে হয়, তার জন্যও তিনি প্রস্তুত।
রাসুলের (সা.) খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। মদিনায়ও তাঁর নাম উচ্চারিত হতে লাগল। এমনকি তখন রাসুলের (সা.) সবচেয়ে বেশি খবর রাখত আউস আর খাজরাজ গোত্রের লোকজন। সমস্ত আরবে তাদের মতো রাসুল (সা.) সম্পর্কে এমন আর কেউ জানত না। তার কারণ, তারা ইহুদি র্যবাইদের পাশে বসবাস করত, র্যাবাইদের প্রবচনের সঙ্গে পরিচিতি ছিল তাদের। মদিনায় রাসুলের (সা.) খবর পৌঁছাল, তারা সবাই শুনল কোরাইশদের সঙ্গে গোলমাল হচ্ছে রাসুলের (সা.)। তখন বনু ওয়াকিফের ভাই আবু কায়েস ইবনে আল-আসলাত একটি পদ্য রচনা করেন।
কোরাইশদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল আবু কায়সের। কারণ, তাঁর স্ত্রী আর্নাব বিনতে আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জার ইবনে কুসায়ির মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল তাঁদের সঙ্গে। একসঙ্গে বছরের পর বছর সস্ত্রীক কোরাইশদের সঙ্গে বাস করেছেন তিনি। একটি গাঁথা রচনা করে তিনি তাতে সমস্ত এলাকার পবিত্রতার গুণকীর্তন করলেন, ওখানে কোরাইশদের হানাহানি করতে বারণ করলেন, সবাইকে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতে বললেন, তাদের সমস্ত দোষ-গুণের বর্ণনা দিলেন, রাসুলকে (সা.) রক্ষা করার পরামর্শ দিলেন এবং যেমন করে আল্লাহ্ তাদের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন, হাতির যুদ্ধে রক্ষা করেছিলেন তাদের, তা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে