শবে মিরাজের উপহার

‘শবে মিরাজ’ শব্দের অর্থ সিঁড়ি, সোপান, উর্ধ্বগমন, বাহন, আরোহণ, উত্থান প্রভৃতি। এটি আল্লাহর কুদরতের মহানিদর্শন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এই অনন্য মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর দাসকে তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য রাত্রে সফর করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, সেখানকার পরিবেশ তাঁরই আর্শীবাদপূত। তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল। ওই রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবা শরিফের হাতিমে অথবা কারও মতে, উম্মে হানির ঘরে ছিলেন। সে সময় জিবরাইল (আ.) সেখানে এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অজু এবং সিনা চাক করিয়ে বোরাকে চড়িয়ে বায়তুল আকসায় পৌঁছালেন। বায়তুল আকসায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সব নবী-রাসুলের ইমামতিতে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এরপর আবার বোরাকে চড়ে সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ করে সপ্তম আকাশের ওপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক জায়গায় পৌঁছান। যেখানে জিবরাইল (আ.) থেমে যান এবং নবী করিম (সা.) একাকী ‘রফরফে’ চড়ে ‘বায়তুল মামুরে’ পৌঁছান।

আল্লাহ তাঁকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের বিশেষ রহস্য বুঝিয়ে দেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করান। সবশেষে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান নিয়ে আবার ঐশীবাহনে আরোহণ করে ফিরে আসেন। সংক্ষেপে এটিই মিরাজের ঘটনা। এর বিস্তারিত বিবরণ হাদিসে রয়েছে। মিরাজের সত্যতায় প্রথম হজরত আবু বকর ( রা.) বিশ্বাস করেন বলে তাঁকে সিদ্দিক বলা হয়।

মিরাজে যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ

মহানবী (সা.)–এর সঙ্গে প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)–এর দেখা হয়। প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি সালাম, কালাম ও কুশল বিনিময় করেন।

তিনি বায়তুল মামুর এবং সিদরাতুল মুনতাহার কাছে যান। (বুখারি শরিফ)

মিরাজের সিদ্ধান্ত

সুরা বনি ইসরাইলে ২২ থেকে ৪৪ আয়াতে আছে, ‘আল্লাহর সঙ্গে অপর কোনো উপাস্য স্থির কোরো না, করলে নিন্দিত ও নিঃসহায় হয়ে পড়বে।’

এ সুরার এর পরের আয়াতগুলো পর পর দেখে যাওয়া যাক: ২৩. ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা না করতে এবং মাতাপিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন। তোমার জীবদ্দশায় ওদের একজন বা দুজনই বার্ধক্যে পৌঁছালেও তাদের ব্যাপারে ‘উহ্ -আহ্’ বোলো না। আর ওদেরকে অবজ্ঞা কোরো না, ওদের সঙ্গে সম্মান করে নম্রভাবে কথা বলবে।’ ২৪. ‘তুমি অনুকম্পার সঙ্গে বিনয়ের ডানা নামাবে, আর বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! ওঁদের ওপর দয়া করো যেভাবে ছেলেবেলায় ওঁরা আমাকে লালনপালন করেছিলেন।’ ২৫. ‘তোমাদের অন্তরে যা আছে তোমাদের প্রতিপালক তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও, আল্লাহ্ তো ক্ষমা করেন তাদেরকে যারা আল্লাহ্ দিকে মুখ ফেরায়।’ ২৬. ‘আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য দেবে এবং অভাবগ্রস্ত ও পথচারীকেও, আর কিছুতেই অপব্যয় কোরো না।’ ২৭. ‘যারা অপব্যয় করে, তারা অবশ্যই শয়তানদের ভাই, আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ ২৮. ‘আর তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের আশায় তোমাকে যদি তাদের (সাহায্যপ্রার্থীদের) কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় তবে নম্রভাবে কথা বোলে।’

২৯. ‘(কৃপণের মতো) তোমার হাত যেন গলায় বাঁধা না থাকে, বা তোমার হাত যেন সম্পূর্ণ খোলা না থাকে, থাকলে তোমার নিন্দা হবে, তুমি সব খুইয়ে ফেলবে।’ ৩০. ‘তোমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছা তার জীবনের উপকরণ বাড়ন যার জন্য ইচ্ছা তা কমান, তিনি তাঁর দাসদের ভালোভাবে জানেন ও দেখেন।’ ৩১. ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্রাভয়ে হত্যা কোরো না। ওদেরকে ও তোমাদেরকে আমিই জীবিকা দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই ওদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।’ ৩২. ‘জিনার (অবৈধ যৌনসংগমের) কাছে যেয়ো না; এ অশ্লীল ও মন্দ পথ।’ ৩৩. ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা কোরো না। কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি, কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে। তাকে তো সাহায্য করা হবে।’ ৩৪. ‘পিতৃহীন বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ছাড়া তার সম্পত্তির কাছে যেয়ো না। আর তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করো, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ ৩৫. ‘মাপ দেওয়ার সময় পুরো মাপ দেবে, আর ঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবে। এ-ই ভালো আর এর পরিণামও ভালো।’ ৩৬. ‘যে-বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তা অনুসরণ কোরো না। কান, চোখ, মন—প্রত্যেকের কৈফিয়ত তলব করা হবে। ৩৭. ‘তুমি মাটিতে দেমাক করে পা ফেলো না। তুমি মাটিও ফাটাতে পারবে না ও পাহাড়ের সমান উঁচুও হতে পারবে না।’ ৩৮. ‘এসবের মধ্যে যেগুলো মন্দ সেগুলো তোমার প্রতিপালক ঘৃণা করেন।’ ৩৯. ‘তোমার প্রতিপালক প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যে-হিকমত দান করেছেন, এগুলো তার অন্তর্ভুক্ত। তুমি আল্লাহর সঙ্গে কোনো উপাস্য গ্রহণ কোরো না। করলে তুমি নিন্দিত হবে ও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বিতাড়িত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ ৪০. ‘তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান ঠিক করেছেন। আর তিনি নিজে ফেরেশতাদেরকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো নিশ্চয় ভয়ানক কথা বলছ!’ ৪১. ‘এই কোরানে আমি বারবার প্রকাশ করেছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে, কিন্তু এতে এদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।’ ৪২. ‘বলো, ওদের কথামতো যদি তার সঙ্গে আরও উপাস্য থাকত তবে তারা আরশের অধিপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় খুঁজত।’ ৪৩. ‘তিনি পবিত্র ও মহিমময়। আর ওরা যা বলে তিনি তার অনেক ওপরে।’ ৪৪. ‘সাত আকাশ ও পৃথিবী আর তাদের মধ্যকার সবকিছু তাঁরই পবিত্র মহিমাকীর্তন করে, আর এমন কিছু নেই যা তাঁর পবিত্র মহিমাকীর্তন করে না। অবশ্য ওদের পবিত্র মহিমাকীর্তন তোমরা বুঝতে পারবে না। তিনি সহ্য করেন, ক্ষমাও করেন।’ (সূত্র: কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০২০)

মিরাজের উপহার

বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে মিরাজ রজনীতে নবী করিম (সা.) এবং তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস প্রদান করা হয়: ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। ২. তাঁর উম্মতদের মধ্যে যাঁরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করে দেবেন। ৩. সুরা আল-বাকারার শেষাংশ। ৪. সুরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশনা।

সুরা বনি ইসরাইলের নির্দেশনা: ১. আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না। ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। ৩. স্বজনদের অধিকার দেবে। ৪. দরিদ্র ও পথসন্তানদের অধিকার দেবে। ৫. অপচয় করবে না। ৬. কৃপণতাও করবে না। ৭. সন্তানদের হত্যা করবে না। ৮. ব্যভিচারী হবে না। ৯. মানুষকে কখনোই হত্যা করবে না। ১০. পিতৃমাতৃহীনদের সম্পদ কেড়ে নিও না। ১১. প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কোরো। ১২. মাপে পূর্ণভাবে দেবে। ১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তা অনুসন্ধান করো। ১৪. অহংকার কোরো না।