মাওলানা রুমির পীর ছিলেন সুফি শামস তাবরিজ। ১২৪৪ খ্রিষ্টাব্দে রুমির সঙ্গে শামস তাবরিজের সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাতের আগে মাওলানা রুমি সেই সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম ও আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানে পারদর্শী পীর ছিলেন। কিন্তু শামস তাবরিজের সংস্পর্শে আসার পর রুমি পুরো বদলে গেলেন। যে রুমি সারাক্ষণ কোরআন-হাদিসের চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, সেই রুমিই অনর্গল কবিতা বলতে শুরু করলেন। শিষ্যরা রুমিকে ভুল বুঝতে শুরু করল। শামস তাবরিজকে তাঁরা এই বলে অপবাদ দিতে শুরু করল যে তাঁর জন্যই রুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছেন।
রুমি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে জীবন-জগতের পরম সত্যকে জানার একমাত্র মাধ্যম হলো প্রেম। শামস তাবরিজ তাঁর মধ্যে সেই প্রেমকে জাগিয়ে দিয়েছেন। ওলি-আউলিয়াদের মর্যাদা বোঝানোর জন্য রুমি তার মসনবিতে এক মুদিদোকানি ও তোতা পাখির গল্পের অবতারণা করলেন। গল্পটি ছিল এ রকম:
এক মুদিদোকানির দোকানে একটি তোতা পাখি ছিল। পাখিটি সুন্দর করে গান গাইতে পারত। তার মিষ্টি কথায় ক্রেতাদের মন ভুলিয়ে দিত। একদিন ওই দোকানি ব্যক্তিগত কাজে বাড়ি গেল। তোতা পাখি দোকান পাহারা দিতে লাগল। সেই সময়ে একটি বিড়াল ইঁদুর ধরার জন্য দোকানের ভেতর লাফ দিলে তোতা পাখিটি ভয় পেয়ে প্রাণভয়ে দোকানের ভেতর উড়তে শুরু করে। এতে তোতার ডানায় লেগে দোকানে থাকা শর্ষের তেলের বোতলগুলো পড়ে গিয়ে পুরো দোকানে তেল ছড়িয়ে পড়ে।
দোকানি ফিরে এসে এটা দেখে খুব রেগে যায়। সে তোতার মাথায় সজোরে আঘাত করলে পাখির মাথার সব পালক ঝরে গিয়ে টাক পড়ে যায়। এ ঘটনার পর তোতা পাখিটি মনের দুঃখে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। দোকানি তাতে অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে তোতার বুলি ফিরে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পাখিটি কিছুতেই আর কথা বলে না।
এভাবেই দিন যায়। একদিন একটি ন্যাড়া দরবেশ সেই দোকানে এলে তোতা পাখির জবান হাসতে হাসতে বলে ওঠে, ‘দরবেশ, তোমার মাথায় এ রকম টাক কেন? তুমিও কি আমার মতো তেলের বোতল ফেলে দিয়েছিলে?’
এই সাদামাটা গল্পে রুমি বলতে চেয়েছেন, আউলিয়ারা নিজেদের নবী-রাসুলদের তুলনা করলে অনেক বড় ভুল করবেন। শুধু মাথার টাক দেখেই তোতা পাখিটি দরবেশকে নিজের সঙ্গে তুলনা করেছিল। কিন্তু দুনিয়ায় অনেক কিছুই দেখতে এক রকম হলেও তাঁর প্রকৃতি ও স্বরূপ একেবারে আলাদা। সাধারণ ওলামারা অনেক সময় ওলি-আউলিয়াদের মর্যাদা বুঝতে অক্ষম হয়ে তাঁদের নিজেদের মতোই সাধারণ মানুষ মনে করে থাকে।
রুমি এই গল্প বলতে গিয়ে কয়েকটি চমৎকার উপমার অবতারণা করে বলেছেন,
‘কা’রে পাকান রা’ কিয়া’স আজ খুদ মাগির
গারচে ম’দান দার নেভিশতান শের ও শির।’
অর্থাৎ, পবিত্রজনদের কাজকে নিজের সঙ্গে তুলনা দিয়ো না, যদিও ‘শের’ ও ‘শির’ শব্দ দুটো একই রকম শোনায়।
ফারসিতে ‘শের’ ও ‘শির’ শব্দ দুটোর বানান হুবহু এক। অথচ প্রথম শব্দটির অর্থ ‘বাঘ’, দ্বিতীয়টির ‘দুধ’। দেখতে এক রকম হলেও একটি মানুষকে খায়, অপরটি মানুষ নিজেই খায়।
রুমি আরও বলেন:
হার দো গুন জাম্বুর খোরান্দ আজ মাহাল
লি-ক শুদ জান নিশ ও জিন দিগার আসাল।
অর্থাৎ, ভ্রমর আর মৌমাছি একই ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে, কিন্তু একজন ওই রস দিয়ে বিষ তৈরি করে, আরেকজন মধু।
রুমি বলতে চান, সাধারণ আলেম আর তত্ত্বজ্ঞানী আলেম একই কোরআন থেকে ধর্মের ব্যাখ্যা দেন। একজন সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বিশৃঙ্খলা ছড়ান, আরেকজন মানুষের মধ্যে প্রেম ছড়িয়ে দেন।
রুমি আরও বলেন:
চুন বাসি ইবলিসে অ’দাম রু হাস্ত
ঈস বেহার দাস্তি নাশা’য়াদ দা’দ দাস্ত।
অর্থাৎ অনেক ইবলিস শয়তান মানুষের রূপে সমাজে বসবাস করে, সুতরাং যার-তার হাতে হাত দেওয়া অনুচিত।
এর মানে হলো, আল্লাহকে অর্জন করতে চাইলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পারদর্শী প্রেমিক পুরুষের সংস্পর্শে গিয়ে অর্জন করতে হবে। সমাজে অনেক মানুষ বুজুর্গের বেশ ধারণ করে কিছু বুলি রপ্ত করে ফাঁদ পেতে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাঁদের অনেক নামধাম থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা বিপজ্জনক। তাঁদের থেকে সতর্ক হতে হবে।
ড. আহসানুল হাদী: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়