হাসির মতো কান্নাতেও মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। হাসি-কান্না মানুষের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ দুটি মানবতত্ত্বের এক নিগুঢ় রহস্য। আল্লাহ–তায়ালা বলেন, তিনিই হাসান ও কাঁদান। (সুরা নাজম, আয়াত: ৪৩)
আল্লাহ্ই মানুষের মধ্যে হাসি-কান্নার উপাদান সৃষ্টি করেছেন।
তাঁর কান্নার ধরন
কান্নার ধরন অনেক। ভয়ের কান্না, বিরহের কান্না, অসহায়ত্বের কান্না, শোক ও বিষণ্নতার কান্না ইত্যাদি। রাসুল (সা.) স্বাভাবিক মানবীয় প্রকৃতির মতোই কোনো আত্মীয় ও প্রিয়জনের মৃত্যুতে কাঁদতেন। এ ধরনের বহু ঘটনা হাদিসের কিতাবে রয়েছে।
ইবনুল কাইয়িম (র.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর কান্না ছিল হাসিরই অনুরূপ। তিনি সশব্দে যেমন হাসতেন না, তেমনই শব্দ করে কাঁদতেনও না। কেবল তাঁর দু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরত। (জাদুল মায়াদ, খণ্ড ১, হাদিস: ১৮৩)
সন্তান–শোকে কান্না
আনাস (রা.) বলেন, (নবী-পুত্র) ইব্রাহিমকে আমি নবীজির(সা.) সামনে মৃত্যুপ্রায় অবস্থায় দেখেছি নবীজির (সা.) দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল। তিনি বললেন, চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় বিষণ্ন হয়। আমার প্রতিপালক যে কথায় সন্তুষ্ট, তা-ই আমরা বলি। ইব্রাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত। (বুখারি, হাদিস: ১,৩০৩)]
আনাস (রা.) বলেন, আমি নবীজির (সা.) এক মেয়ের (দাফনের) সময় উপস্থিত ছিলাম। তিনি কবরের পাশে বসে ছিলেন। দেখলাম, তার দু চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরছে। (বুখারি, হাদিস: ১২৮৫)
পরিবারের সদস্যদের বিয়োগে কান্না
ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, নবীজির (সা.) কন্যা তাঁর কাছে খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর সন্তান মৃতপ্রায়। তিনি কয়েকজন সাহাবিসহ সেখানে গেলেন। শিশুটিকে নবীজির কোলে তুলে দেওয়া হলো। তখনো শিশুটির প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। (বর্ণনাকারী বলেন,) আমি ধারণা করছি তিনি বলেছিলেন, মনে হয় যেন একটি চামড়ার পাত্র। তারপর তাঁর দু চোখ অশ্রু ঝরাতে লাগলো। সাদ (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসুল, এ কী? নবীজি (সা.) বললেন, এটাই মমতা, যা আল্লাহ তার বান্দাদের অন্তরে রেখেছেন। আল্লাহ–তাআলা তার দয়ালু বান্দাদেরই দয়া করেন। (মুসলিম, হাদিস: ৯২৩)
সাহাবিদের ভালোবাসায় কান্না
আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুল (সা.) যায়েদ ও তার সঙ্গীদের শাহাদাতের সংবাদ দিয়ে বললেন, যায়েদ পতাকা তুলে নিয়েছে। সে শহিদ হলো। তারপর জাফর পতাকা ধরেছে। সে-ও শহিদ হয়ে গেল। এবার আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা হাতে নিয়েছে। সে-ও শহীদ হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজির (সা.) দু চোখ তখন অশ্রু ঝরাচ্ছিল। (বুখারি, হাদিস: ৩,০৬৩)
কখনো কখনো তিনি এত বেশি বেদনাহত হতেন যে তাঁর হৃদয়ে ছাপ থেকে যেত। একসঙ্গে অনেক ক্বারীর শাহাদাতের ঘটনা সম্পর্কে আনাস (রা.) বলেন, নবীজিকে (সা.)এর চেয়ে বেশি বেদনাহত হতে আমি আর দেখিনি। (মুসলিম, হাদিস: ৬৭৭)
নামাজে কাঁদা
নামাজে নবীজি(সা.)কে প্রায়ই কাঁদতে দেখা যেত। কখনো সাহাবিরা জানতে পারতেন, কখনো বুঝতেও পারতেন না যে নবীজি (সা.)কাঁদছেন। কেবল তাঁর দু চোখ ছাপিয়ে অশ্রু ঝরে যেত। আবার কখনো নামাজে তেলাওয়াতের সময় কান্নায় গলা ভারী হয়ে আসত।
আবদুল্লাহ ইবনে শিখখির (রা.) তাঁর পিতার বর্ণনা নকল করেন এইভাবে যে, একবার নবীজির (সা.) কাছে গিয়ে দেখি, তিনি নামাজ পড়ছেন, আর তাঁর বুক থেকে কান্নার এমন শব্দ বের হচ্ছে, যেন চুলায় রাখা পানির পাত্র টগবগ করে ফুটছে।
তিনি আবার কখনো কখনো সেজদায় পড়েও কাঁদতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, একবার সূর্যগ্রহণের সময় নবীজি (সা.)নামাজে দাঁড়িয়ে গিয়ে দীর্ঘ রুকু-সেজদা করলেন। সেজদায় গিয়ে মনে হলো তিনি আর উঠবেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আর কাঁদছিলেন। দোয়ার মধ্যে বলছিলেন, হে আমার প্রতিপালক, আপনি কি আমাকে এই প্রুতশ্রুতি দেননি যে, আমার উপস্থিতিতে উম্মতকে শাস্তি দেবেন না। (নাসায়ি, হাদিস: ১,২১৪)
কোরআন শুনে কান্না
কোরআনে আজাবের আয়াত পাঠের সময় কাঁদা নবীজির (সা.)সুন্নাত ছিল। সাহাবিদের কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনেও তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)একদিন আমাকে বললেন, আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে আপনার ওপর আর আমি আপনাকে পড়ে শোনাব? নবীজি (সা.)বললেন, আমি অন্যের কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছি। ইবনে মাসউদ (রা.) সূরা নিসা তিলাওয়াত করলেন। যখন এ আয়াতে এলেন, ‘তখন কী অবস্থা হবে, যখন আমি ডেকে আনব প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে সাক্ষী এবং আপনাকে ডাকব তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে’ (সুরা নিসা, আয়াত ৪১)। আমি দেখলাম নবীজির (সা.) চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। (বুখারি, হাদিস: ৪,৬৮২)
আবেগ ও বিনয়ের কান্না
কিছু কিছু সময়ে নবীজির (সা.)মধ্যে বিশেষ আবেগ ও বিনয় কাজ করত। তার মধ্যে অন্যতম হলো, হাজরে আসওয়াদ। নবীজি (সা.) একবার হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন। ফিরে এসে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তখন কান্নায় তাঁর অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। (বাইহাকি, হাদিস: ৭২৩৪)
এ-ছাড়া যখন আবু তালিব কাফেরদের পীড়াপীড়িতে নবীজি (সা.)কে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বললেন, তখনও তিনি চাচা আবু তালিবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কেঁদে ফেলেছিলেন। (সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস: ৩,৬৭৫)