হজের আধ্যাত্মিক শিক্ষা

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে হজ। ‘হজ’ অর্থ—কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা।

হজের নিয়তসহ ইহরাম পরিধান করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা এবং পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ করাকে হজ বলে। পবিত্র এই দিনে মহান আল্লাহর কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পাপমুক্তির আকুল কামনায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। এরপর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন।

মূলত হজ মুসলমানের জন্য একটি ফরজ ইবাদত। এটিকে মিশ্র ইবাদতও বলা হয়। কেননা এতে শারীরিক শক্তি ও অর্থ ব্যয়—দুটিরই প্রয়োজন। ইসলামে হজের অনেক গুরুত্ব রয়েছে।

হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত করে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হজের ঘোষণা দেন। তাঁর এ ঘোষণা তখন পৃথিবীতে বিদ্যমান ও কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

কিয়ামত পর্যন্ত যাঁরা হজ করবেন, তাঁরা সেদিন ইবরাহিম (আ.)-এর ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/২৬০)

হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর প্রকৃত হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি: ১/২০৬)

সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ সম্মেলন হলো হজ। এটি উম্মাহর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ সৃষ্টির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রকৃত নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। হজ ধনসম্পদ, বর্ণ-গোত্র কিংবা জাতীয়তার দিক থেকে ভেদাভেদ ভুলিয়ে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়।

রাজা, প্রজা, মালিক, ভৃত্য—সবাইকে সেলাইবিহীন একই কাপড় পরিধান করায়। একই উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে সাম্যের আহ্বান জানায়। হজ মানুষকে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষা দিয়ে সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলে।

হজ পালন করে মুসলমানরা একদিকে যেমন আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন, অন্যদিকে আল্লাহর পথে আরও দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠভাবে চলার জন্য মনস্থির করেন এবং বাস্তব শিক্ষা অর্জন করেন। আল্লাহ তাআলা বান্দার ওপর কালিমা, নামাজ, রোজা, জাকাত, হজের মতো কিছু বিধান পালন বাধ্যতামূলক করে দিলেও এসবের মধ্যে বান্দার জন্য বহুবিধ উপকারিতা রেখেছেন।

পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়া পাহাড় দ্বয়ের মধ্যে দৌড়ানো, মিনার জামারায় পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি ইত্যাদি হজের ইবাদত। এর প্রতিটি ইবাদতের মধ্যেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। এগুলোর সঙ্গে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা–বিশ্বাস, আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ করো।’ (আল–ইমরান)

কোনো মুসলমানের ওপর যে বছর হজ ফরজ হয়, সে বছরই তা আদায় করা উচিত। অযথা বিলম্ব করা গুনাহ। হজ একবার ফরজ হলে তা আর কখনো মাফ হয় না। (আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫২৮)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের ইচ্ছা করে, সে যেন তা দ্রুত আদায় করে নেয়। কেননা মানুষ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো সম্পদ খরচ হয়ে যায়, কখনো সমস্যার সম্মুখীন হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২০৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘হজ ফরজ হওয়ার পর তা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করা আর ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ (তিরমিজি: ১/১৬৭)

বিশ্বের সব মুসলমান সচেতনভাবে ইসলামিক বিধিবিধান অনুযায়ী হজ পালন করলে, হজের সম্মিলনকে আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি এর অন্যান্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও উপকারিতা গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করলে প্রকৃতপক্ষেই হজ মুসলমানদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর হয়ে উঠবে ইনশা আল্লাহ।

হজ শুধু একটি সাধারণ ইবাদতই নয়, এটি আল্লাহর সঙ্গে বান্দার প্রেমের সফরও বটে। হাজিরা ছুটছেন কাবার পথে। দুচোখে তাঁদের কাবার ছবি। হৃদয়জুড়ে ভক্তি, ভালোবাসা আর প্রেমের ঢেউ। পৃথিবীর সব প্রেম, সব ভালোবাসা তুচ্ছ এ প্রেমের আঙিনায়।

মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এক গভীর আকর্ষণ অনুভূত হয় হাজিদের দেহ-মনজুড়ে। পাগলপারা হয়ে ছুটে যান হাজিরা, পবিত্র সেই ভূমির পথে।

কিন্তু কেন এই আকুলতা! হৃদয়জুড়ে এত ব্যাকুলতা! এই ব্যাকুলতা যে প্রেমের, ভালোবাসার। আল্লাহর আদেশ মেনে, তাঁর সঙ্গে তাঁর গৃহে এসে দেখা করার চেয়ে বড় সুযোগ আর কীই–বা হতে পারে। এই মহান নিয়ামতের সামর্থ্য যাঁদের আছে, সত্যিই তাঁরা সৌভাগ্যবান।

হজের প্রতিটি আমল ঠিকমতো পালন করলে তা মুমিন বান্দার জীবনাচারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আল্লাহর পথের মেহমান ও যাত্রীদের হৃদয়ের অ্যালবামে একে একে ভেসে থাকে পবিত্র নগরী বায়তুল্লাহ, মিনা, মুজদালিফা, সাফা-মারওয়া, মাকামে ইবরাহিম আর আরাফাতের ময়দানের নয়নজুড়ানো সেই দৃশ্যাবলি।

পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘অবশ্যই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ নির্মিত হয়েছিল, তা মক্কায় অবস্থিত; যা বরকতময় ও পৃথিবীবাসীর জন্য পথের দিশারি। এতে রয়েছে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন ও মাকামে ইবরাহিম। যদি কেউ সেথায় প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তা লাভ করে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের ওপর হজ করা একান্ত আবশ্যক; সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য যে রাখে, তার জন্য এই বিধান। আর যে অস্বীকার করে, সে জেনে রাখুক, আল্লাহ পৃথিবীবাসীর কাছে অমুখাপেক্ষী।’ (সুরা আল-ইমরান: ৯৬-৯৭)

কিয়ামত পর্যন্ত এটি শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবে। অশান্তির দাবানলে পুড়ে পুড়ে ছাই আজকের এই বিশ্বসভ্যতার ভেতরে–বাইরে কোথাও নেই শান্তির পরশ। তাই বিশ্বাসী বান্দারা আত্মার প্রশান্তি লাভের নিমিত্তে ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসেন পবিত্র এই কাবার প্রান্তরে।

আল্লাহ আমাদের আজীবনের লালিত স্বপ্ন হজ তাঁর হুকুম ও রাসুলের সুন্নত অনুযায়ী যথাযথভাবে পালনের সামর্থ্য এবং এর শিক্ষা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: পেশ ইমাম, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম

প্রথম আলো হজ গাইড পড়তে ক্লিক করুন