সাইয়িদা খাদিজা (রা.) কী কী নীতি ও কৌশল মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতেন, এই লেখার প্রথম পর্বে আমরা তার কিছু কিছু আলোচনা করেছি। এই পর্বে তাঁর আরও কিছু নীতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো।
৬. ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষা করা
ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতেন সাইয়িদা খাদিজা (রা.)। স্বামী বিয়োগের পর মক্কার অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছেন, এমনকি তাদের ব্যবসায় অংশীদারত্ব প্রদানের প্রস্তাবও করেছেন; কিন্তু সাইয়িদা খাদিজা (রা.) সংযতভাবে সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন মূলত দুটি কারণে। এক. কোনোভাবেই তিনি তার ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিতে চাননি। দুই. ব্যবসায় তিনি নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে চাননি।
ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তা রজায় রেখে ব্যবসা করাকে বর্তমান সময়ের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। এটিই ব্যবসার ব্র্যান্ডভ্যালু। বর্তমান সময়ের স্বীকৃত ও সফল বিজনেস বিশেষজ্ঞরা ব্র্যান্ডভ্যালুর প্রতি যত্নবান হওয়ার উপদেশ প্রদান করেন। ‘ব্র্যান্ডিং আপনার পণ্যকে অন্য পণ্য থেকে আলাদা করে রাখে। ব্র্যান্ড হলো আইডেন্টিটি বা পরিচয়। সময় পাল্টায়, যুগ বদলায় কিন্তু ব্র্যান্ডের প্রতিজ্ঞা এক বিন্দুও পরিবর্তিত হয় না।’ (বিজনেস ব্লুপ্রিন্ট, কোচ কাঞ্চন, আদর্শ, পৃষ্ঠা ১২৫-১৩০) প্রতিষ্ঠানকে যখন মানুষ বিশ্বাস করবে, তখন ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হবে।
৭. আমানতদার ও বিশ্বস্ত কর্মী নিয়োগ
ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনে ব্যবস্থাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারিতা এবং বিশ্বস্ততার গুণকে প্রাধান্য দিতেন সাইয়িদা খাদিজা (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কারণও ছিল এগুলোই। সরাসরি যেহেতু তিনি সফরে যেতেন না তাই সৎ, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যবস্থাপকের খুব দরকার ছিল তার এবং এমনটাই খুঁজে ফিরতেন তিনি প্রতি মৌসুমে; প্রতিবার লোক নিয়োগের সময়।
ব্যবসা জীবনের এক বাঁকে খাদিজার কাছে পৌঁছে যায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সততা, আমানতদারিতা এবং উত্তম চরিত্রের কথা। যথাযোগ্য মানুষ চিনতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি তিনি। দ্রুততম সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তার সম্পদ নিয়ে শামে ব্যবসা করতে যাওয়ার প্রস্তাব পাঠান। খাদিজা তাঁর প্রস্তাবে এও উল্লেখ করেন—সাধারণ কোনো ব্যবস্থাপককে যে লভ্যাংশ দেওয়া হয় রাসুলুল্লাহ (সা.) রাজি হলে এর দ্বিগুণ মুনাফা দেওয়া হবে তাকে। ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতার জন্য সঙ্গে একজন ভৃত্যও দেওয়া হবে। (উসদুল গাবাহ, ইবনুল আসির জাজারি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৮০)
আমানতদার, বিশ্বস্ত লোকবল একটি প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ সফল হওয়ার অন্যতম নেপথ্য শক্তি। প্রত্যেক মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী, সিইও বা ব্যবস্থাপক নিয়োগের সময় অবশ্যই সে আমানতদার এবং বিশ্বস্ত কিনা তা যাচাই করতে হবে। ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ জেনিফার হেরিটি ‘ভালো ম্যানেজার বা কর্মীর ১২টি গুণ’ নিবন্ধে এসব গুণের কথা উল্লেখ করেছেন।’ (‘টুয়েলভ স্কিলস অব আ গুড ম্যানেজার’, জেনিফার হেরিটি, ইনডেড.কম)
৮. যথার্থ মানবসম্পদের সরবরাহ
সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য যথার্থ মানবসম্পদের জোগান দেওয়া বা ব্যবসা পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যবস্থাপককে লোকবল দিয়ে সহযোগিতা করা ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যবস্থাপক হিসেবে সফরে যাওয়ার জন্য খাদিজা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতার জন্য সাথে ভৃত্যও দেওয়া হবে। এ বিষয়টিও খাদিজার ব্যবসায়িক পারদর্শিতা এবং দক্ষ পরিচালনাগুণের প্রমাণ বহন করে।
যথার্থ লোকবলের অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় সফল হতে পারে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে শুরুতেই মাথা ভারী করে ফেলে। অপর্যাপ্ত ও অতিরিক্ত লোকবল এবং অনভিজ্ঞ লোকবল কোনোটাই প্রতিষ্ঠানের জন্য সুখকর নয়। যেখানে যতটুকু লোকবল না হলেই নয়, সেখানে ততটুকু লোকবল অবশ্যই নিতে হবে।
বিজফ্লুয়েন্ট নামে একটি পোর্টালে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ ডানিয়েল স্মিথ ‘দ্য ইমপরটেন্সি অব ম্যানপাওয়ার ইন প্ল্যানিং’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সঠিক জনশক্তি বা লোকবল পরিকল্পনা সাংগঠনিক কৌশলের মূল চাবিকাঠি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সফল হওয়ার নেপথ্য সূত্র। সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে সঠিক লোকবল সরবরাহের ওপর ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে।
৯. বাণিজ্যিক সফরে অভিজ্ঞ লোক মনোনয়ন
খাজিদা (রা.) শামের সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মাইসারাকে পাঠানোর অন্যতম কারণ ছিল যে তিনি মাইসারা ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ, ভদ্র ও পরিশ্রমী। তিনি এর আগেও শামে সফর করেছিলেন এবং ওখানকার বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে তাঁর ভালো জানাশোনা ছিল। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ০১/১৩০; সীরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৪)
যে দেশ বা স্থান থেকে পণ্যদ্রব্য আনার জন্য লোক পাঠানো হচ্ছে সে দেশ বা স্থান সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকবলকে বাণিজ্যসফরে পাঠানোর পক্ষে প্রায় সব বিশেষজ্ঞই মতামত দিয়েছেন। চেনাজানা অভিজ্ঞ লোক হলে বাণিজ্যসফরে অনেক সুবিধা অর্জন করা সম্ভব।
১০. চুক্তির অতিরিক্ত পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ প্রদান করা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে শামের বাণিজ্যসফরে বুসরা বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রিতে অতীতের সব সফরের তুলনায় বিপুল লাভ হলো। বুসরা থেকে ক্রয় করে আনা পণ্যদ্রব্য মক্কায় বিক্রি করেও বিপুল মুনাফা অর্জিত হলো। এ অর্জনে খুশি হয়ে খাদিজা (রা.) রাসুলুল্লাহকে চুক্তির অতিরিক্ত পারিশ্রমিক-লভ্যাংশ দিয়েছিলেন। (দালায়িলুন নুবুওয়াহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪; সীরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৭)
কর্মী বা ব্যবস্থাপক বা পরিচালকদের চুক্তির অতিরিক্ত পারিশ্রমিক বা লভ্যাংশ প্রদান প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠানের প্রতি এবং কাজের প্রতি তাদের মনোযোগ বাড়ায়। এতে প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুরস্কৃত করায় কর্মীদের কাজে আগ্রহ বেড়েছে। আবার পুরস্কার না দিলে কর্মীদের আগ্রহ কমতে শুরু করে। দ্য বিজনেস জার্নাল–এর গবেষণা বলছে, ‘কর্মচারীদের চুক্তির অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদান প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করে তুলতে সহযোগিতা করে। এর মাধ্যমে সেরা ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী খুঁজে বের করা সম্ভব হয় এবং এর মাধ্যমে টিমওয়ার্ক উন্নত হয়।’ (‘ওয়ার্কপ্লেস ইনসেন্টিভস দ্যাট ইয়োর এমপ্লয়িজ ওয়ান্ট’, আদ্রিয়ান ক্রসিনে, বিজনেসনিউজ ডেইলি.কম, আগস্ট ১৩, ২০২২)
মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক