আমর ও আবদুল্লাহ্ কোরাইশদের কাছে ফিরে এল খালি হাতে। রাসুলে করিমের (সা.) সাহাবিদের আনতে পারেনি তারা, মাঝখান থেকে নিগাসের কাছে লাভ করেছে তীক্ষ্ণ গঞ্জনা। এদিকে উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি খুব কঠিন লোক, শক্ত-সমর্থ ও একগুঁয়ে। তাঁর আশ্রিতজনদের আক্রমণ করে—এমন সাহস কারও নেই। তিনি এবং হামজার বলে বলীয়ান হয়ে রাসুলে করিমের (সা.) সাহাবিরা নিজেদের অবস্থান কোরাইশদের তুলনায় দৃঢ়তর করে ফেললেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বলতেন, ‘উমরের মুসলমান হওয়ার আগে আমরা কাবায় নামাজ পড়তে পারতাম না। তারপর উমর কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে করে করে কাবায় নামাজ পড়লেন, তাঁর সঙ্গে আমরাও পড়লাম।’ রাসুলে করিমের (সা.) সাহাবিরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করার পর উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
সাদ ইবনে ইব্রাহিমের সূত্রে মিসার ইবনে কিদাম বলেছেন যে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বলেছেন, ‘উমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল এক বিজয় বিশেষ, তাঁর মদিনায় হিজরত ছিল বড় রকমের সাহাঘ্য, আর তাঁর প্রশাসন ছিল এক ঐশী অনুগ্রহ। তাঁর মুসলমান হওয়ার আগে আমরা কাবায় নামাজই পড়তে পারতাম না। তারপর তিনি কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে কাবায় ঢুকলেন, সেখানে নামাজ পড়লেন, তাঁর সঙ্গে পড়লাম আমরা।’
আবদুর রহমান ইবনে আল-হারিস ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আইয়াশ ইবনে আবু রাবিয়া বলেছেন, আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আমির ইবনে রাবিয়ার সূত্রে এবং তিনি পেয়েছেন তাঁর মা উম্মে আবদুল্লাহ্ বিনতে আবু হাসমা সূত্রে। জানা যায়, উম্মে আবদুল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমাদের তখন আবিসিনিয়া যাওয়ার দশা। আমির গিয়েছিল বাইরে কিছু দরকারি জিনিস আনতে। উমর এসে দাঁড়াল আমার পাশে। তখন সে বহু-ঈশ্বরবাদী। তার কাছ থেকে তখন বড় দুর্ব্যবহার, বড় যাতনা পাচ্ছিলাম আমরা। পাশে দাঁড়িয়ে উমর বলল, “তাহলে উম্মে আবদুল্লাহ্, তুমিও যাচ্ছ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমরা আল্লাহ্র দেশে যাচ্ছি। তোমরা তো খুনির মতো ব্যবহার করলে আমাদের সঙ্গে। এখন আল্লাহ্ আমাদের জন্য একটা পথ খুলে দিয়েছেন।” উমর তখন বলল, “ঠিক আছে, আল্লাহ্ তোমাদের সহায় হোন।” তখন আমি দেখলাম উমরের চোখে-মুখে একটা কোমল সজল ভাব। এমনটি ওর চেহারায় আমি আগে কোনো দিন দেখিনি। ও চলে গেল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমরা চলে যাব এটা তার কাছে খুব পীড়াদায়ক মনে হচ্ছে। দরকারি জিনিস নিয়ে একটু পর ফিরে এল আমির। আমি তাকে বললাম, “একটু আগে উমর এসেছিল, আহা! ওর চোখে-মুখে আমাদের জন্য মায়া আর দুঃখ যেমন উথলে উঠছিল, তুমি যদি দেখতে আবদুল্লাহ্র বাপ!” তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ও মুসলমান হবে বলে আমার আশা আছে কি না। আমি বললাম, আছে। তার উত্তরে তিনি বললেন, “যে লোকটাকে তুমি দেখেছ, আল খাত্তাবের গর্দভটিও মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে না।” ইসলাম নিয়ে তাঁর রূঢ়তা ও বিদ্বেষের কথা ভেবে গভীর হতাশায় তিনি এসব বলেছিলেন।’
আমি যত দূর শুনেছি, উমরের ইসলাম গ্রহণের বৃত্তান্ত নিম্নরূপ:
তাঁর বোন ফাতিমা বিনতে আল-খাত্তাবের বিয়ে হয়েছিল সাদ ইবনে জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়লের সঙ্গে। তাঁরা দুজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। সে সংবাদ উমরের কাছে গোপন রাখলেন। এদিকে তাঁরই গোত্রের বনু আদি ইবনে কাবের বংশের নুয়ায়ম ইবনে আবদুল্লাহ্ আন-নাহহামও ইসলাম গ্রহণ করে আত্মীয়স্বজনের ভয়ে সেই কথা গোপন রাখলেন। খাব্বাব ইবনে আস-আরাত প্রায়ই ফাতিমার কাছে এসে তাঁকে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। একদিন উমর বেরিয়ে এলেন। হাতে তলোয়ার। তিনি রাসুল আর তাঁর সাহাবিদের চান। রাসুল এবং তাঁর সাহাবিরা প্রায় জনা চল্লিশেক লোক তখন আস-সাফার বাড়িতে জমায়েত হয়েছিলেন। তার মধ্যে মহিলাও ছিল। রাসুলে করিম [সা.]-এর সঙ্গে ছিলেন তাঁর পিতৃব্য হামজা, আবু বকর ও আলী। তাঁরা সবাই মুসলমান হয়েছিলেন কিন্তু আবিসিনিয়ায় হিজরত করেননি।
নুয়ায়মের সঙ্গে দেখা হলো উমরের। নুয়ায়ম তাঁকে কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করলেন। উমর বললেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী মুহাম্মদকে ধরতে যাচ্ছি, যে মুহাম্মদ কোরাইশদের মধ্যে ভাঙন এনেছে, তাদের আচার-অনুষ্ঠানকে উপহাস করেছে, তাদের ধর্মবিশ্বাসকে অপমান করেছে, তাদের দেবদেবীদের অপমান করেছে, তাকে আমি হত্যা করব।’
নুয়ায়ম বললেন, ‘তুমি বুঝতে পারছ না, উমর, কী তুমি করতে যাচ্ছ। তুমি কি মনে করো, মুহাম্মদকে হত্যা করলে বনু আবদু মানাফ তোমাকে দুনিয়ার মাটিতে হাঁটতে দেবে? এর চেয়ে তুমি নিজের বাড়ি গিয়ে নিজের ঘর ঠিক করো না কেন?’
উমর বললেন, ‘আমার ঘরের আবার কী হয়েছে?’
‘তোমার ভগ্নিপতি, তোমার ভাতিজা সাঈদ, তোমার বোন ফাতিমা—সবাই তো মুসলমান হয়ে গেছে। তারা এখন মুহাম্মদের ধর্ম পালন করে। কাজেই আগে গিয়ে তাদের ঠিক করো তুমি।’
উমর ফিরে এলেন বোনের বাড়িতে। বোন এবং ভগ্নিপতিকে তখন খাব্বাব পাণ্ডুলিপি থেকে সুরা তা-হা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। উমরের গলা শুনেই খাব্বাব একটি ছোট কুঠরিতে বা বাড়ির এক কোণে গিয়ে লুকালেন। কাগজের পাতাটি ফাতিমা ঊরুর নিচে লুকিয়ে ফেললেন। এদিকে উমর কিন্তু বাড়ির কাছে এসে খাব্বাবের পাঠ শুনে ফেলেছেন। কাজেই ঢুকেই তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘ওটা কী বাজে জিনিস আমি শুনলাম?’
তাঁরা বললেন, ‘কিছু শোনোনি তুমি।’
উমর বললেন, ‘আল্লাহ্র কসম, আমি শুনেছি। আমি আরও শুনেছি তোমরা মুহাম্মদের ধর্ম অনুসরণ করছ।’
উমর ভগ্নিপতি সাঈদকে ধরে ফেললেন বলার সঙ্গে সঙ্গেই। ফাতিমা উঠে এসে স্বামীকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন। উমর ফাতিমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলেন। পড়ে গিয়ে ফাতিমা আঘাত পেলেন। এমনি উন্মাদের মতো আচরণ করছিলেন যখন উমর। তখন তাঁরা দুজন বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা মুসলমান, আমরা আল্লাহ্তে এবং তাঁর রাসুলের ওপর ইমান এনেছি। তোমার এখন যা খুশি করতে পারো।’
উমর বোনের রক্ত দেখলেন। খারাপ লাগল তাঁর, বোনের রক্তপাত ঘটিয়েছেন তিনি। তিনি ফিরে দাঁড়ালেন। বোনকে বললেন, ‘ঠিক আছে, ওই কাগজটা তোমরা যে পড়ছিলে আনো এটা আমাকে দাও, আমি দেখব কী জিনিস মুহাম্মদ এনেছে।’ উমর লেখাপড়া জানতেন, তিনি লিখতে পারতেন।
তাঁর কথার জবাবে তাঁর বোন জানালেন, উমরকে তা দিতে তিনি ভরসা পাচ্ছেন না।
উমর বললেন, ‘ভয় নেই।’
দেবদেবীর নাম নিয়ে কসম খেলেন, পড়া হলে সে কাগজ তিনি ফেরত দেবেন। শুনে ফাতিমার মনে আশার সঞ্চার হলো, হয়তো তিনি মুসলমান হতে পারেন। বললেন, ‘ভাইজান, আপনি বহু-ঈশ্বরের পূজা করেন, আপনি তাই অপবিত্র। কেবল পাক মানুষ এটা স্পর্শ করতে পারে।’
উমর উঠলেন, অজু করলেন। তখন ফাতিমা সুরা তা-হা লেখা কাগজখানি তাঁকে প্রদান করলেন। শুরুটা পড়েই তিনি বলে উঠলেন, ‘কী সুন্দর, কী মহান কথা!’
এ কথা শুনেই লুকানোর স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন খাব্বার। বললেন, ‘আল্লাহ্র নামে বলছি উমর, আমার মনে হয় আল্লাহ্ তাঁর রাসুলের ডাকের ভেতর দিয়ে আপনাকে এক বিশেষ আসন দেবেন। আমি কাল রাতেই রাসুলকে (সা.) বলতে শুনেছি, “ইয়া আল্লাহ্! আবুল হাকাম ইবনে হিশাম অথবা উমর বিন আল-খাত্তাবকে দিয়ে ইসলামকে মজবুত করো।” উমর! আল্লাহ্র পথে আসুন, আল্লাহ্র কাছে আসুন।’
উমর তখন বললেন, ‘ঠিক আছে, আমাকে নিয়ে চলো মুহাম্মদের কাছে। ইসলাম গ্রহণ করব।’ খাব্বাব বললেন, রাসুলে করিম (সা.) কতিপয় সাহাবির সঙ্গে আস-সাফার বাড়িতে আছেন। উমর কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে রাসুলে করিম (সা.) এবং তাঁর সাহাবিদের উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি তাঁদের দরজায় এসে আঘাত করলেন। তাঁরা সবাই উমরের গলা শুনে চিনতে পারলেন। একজন সাহাবি দরজার ফাঁক দিকে বাইরের দিকে তাকালেন, দেখলেন খোলা তলোয়ার হাতে উমর দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি রাসুলের কাছে গিয়ে বললেন, ‘উমর তলোয়ার নিয়ে এসেছে।’
হামজা বললেন, ‘ওকে আসতে দাও। ও যদি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকে, আমরা ভালো ব্যবহার করব। আর যদি বদ মতলব নিয়ে এসে থাকে, ওর তলোয়ার দিয়েই ওকে হত্যা করব আমরা।’
রাসুলে করিম (সা.) হুকুম দিলেন। প্রবেশ করলেন উমর।
রাসুলে করিম (সা.) উঠে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, তাঁর কোমর কিংবা মধ্যাঙ্গের পরিচ্ছদ জড়িয়ে ধরলেন, জোরে তাঁকে টান দিলেন, বললেন, ‘কেন এসেছেন ইবনে খাত্তাব? এখনো কি আল্লাহ্র পথে আসার সময় হয়নি আপনার?’
উমর বললেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ্, আমি আপনার কাছে এসেছি আল্লাহ্র ওপর আর তাঁর রাসুলের ওপর, রাসুল আল্লাহ্র কাছ থেকে যা বহন করে এনেছেন তার ওপর ঈমান আনার জন্য।’
রাসুলে করিম (সা.) এত জোরে আল্লাহ্র কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন যে তাতে বাড়ির সব মানুষ টের পেয়ে গেল উমর মুসলমান হয়েছেন।
সাহাবিরা চলে গেলেন। উমর ও হামজা উভয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এখন আর ভয় নেই। রাসুলকে তাঁরাই রক্ষা করবেন। তাঁদের মাধ্যমেই তাঁদের দুশমনদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এখন থেকে।
উমরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এই হলো মদিনাবাসী হাদিসবেত্তাদের ভাষ্য।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে