হজরত আমর ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.)-র বরাতে এই হাদিসটির বর্ণনা আছে। তিনি নবী (সা.)-এর কাছে নিচের ঘটনাটি শুনেছেন।
আল্লাহর রাসুল (সা.) দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠালেন। আসিম ইবনে উমর ইবনে খাত্তাবের নানা আসিম ইবনে সাবিত আনসারিকে তিনি তাঁদের দলপতি নিয়োগ করলেন। তাঁরা রওনা দিলেন। উসফান ও মক্কার মাঝখানে হাদআত নামে একটি স্থানে তাঁরা পৌঁছালেন।
লেহইয়ান’ নামে পরিচিত হুযায়েল গোত্রের একটি প্রশাখার মধ্যে তাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁদের ধাওয়া করার জন্য তারা প্রায় ২০০ তীরন্দাজ পাঠায়। এরা তাঁদের চিহ্ন দেখে চলতে থাকে। সাহাবিরা যেখানে বসে মদিনা থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা খেজুর খেয়েছিলেন, তারা সে জায়গাটির সন্ধান পেয়ে গেল। তারা বলল, ইয়াসরিবের খেজুর।
এর পর তারা তাঁদের পদচিহ্ন দেখে চলতে লাগল। আসিম ও তাঁর সঙ্গীরা ওদের দেখতে পেয়ে একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেন। অবিশ্বাসীরা তাঁদের ঘিরে ফেলে বলতে লাগল, তোমরা নেমে এসে আত্মসমর্পণ করো। আমরা অঙ্গীকার করছি ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তোমাদের কাউকে আমরা হত্যা করব না।
তখন গোয়েন্দা দলের নেতা আসিম ইবনে সাবিত (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি আজকে অবিশ্বাসীদের নিরাপত্তায় নামব না। হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন।’
অবশেষে কাফিররা তীর ছুঁড়তে শুরু করল। আসিম (রা.)–সহ সাতজনকে তারা শহীদ করল। শেষ তিনজন খুবাইব আনসারি, যায়দ ইবনে দাসিনা (রা.) আর অন্য আরেকজন তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে তাদের কাছে আসলেন। যখন কাফিররা তাদের আয়ত্তে নিয়ে নিল, তখন তারা তাদের ধনুকের রশি খুলে ফেলে তাঁদের বেঁধে ফেলল।
তখন তৃতীয় জন বলে উঠলেন, ‘গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। যাঁরা শহীদ হয়েছেন আমি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব।’ কাফিররা তাঁকে শহীদ করে ফেলে এবং তারা খুবাইব ও ইবনে দাসিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাঁদের উভয়কে মক্কায় বিক্রয় করে ফেলে। এটা বদর যুদ্ধের পরের কথা। তখন খুবাইবকে হারিস ইবনে আমিরের পুত্ররা ক্রয় করে নেয়।
বদর যুদ্ধের দিন খুবাইব (রা.) হারিস ইবনে আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবাইব (রা.) কিছুদিন তাদের কাছে বন্দী থাকেন। ইবনে শিহাব (র.) বলেন, আমাকে উবায়দুল্লাহ ইবনে আয়ায জানিয়েছেন, তাঁকে হারিসের কন্যা জানিয়েছে যে যখন হারিসের পুত্রেরা খুবাইব (রা.)-কে শহীদ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার কাছ থেকে ক্ষৌরকর্ম করার উদ্দেশে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন।
তখন হারিসের কন্যা তাকে একটা ক্ষুর ধার দিল। সে সময় ঘটনাক্রমে এক ছেলে আমার অজান্তে খুবাইবের কাছে চলে যায়। আমি দেখি আমার ছেলে খুবাইবের ঊরুর ওপর বসে রয়েছে এবং খুবাইবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুবাইব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় কর যে, আমি এ শিশুটিকে হত্যা করে ফেলব? কখনো আমি তা করব না। আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের মতো উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদা দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া হতে আঙুর খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কায় কোনো ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিসের কন্যা বলত, এ তো ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবাইবকে দান করেছেন।
অতঃপর তারা খুবাইবকে শহীদ করার উদ্দেশে হারামের কাছ থেকে হিল্লের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল, তখন খুবাইব (রা.) তাদের বললেন, আমাকে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে দাও। তারা তাঁকে সে অনুমতি দিল। তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা যদি ধারণা না করতে যে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি, তবে আমি নামাজকে দীর্ঘ করতাম। হে আল্লাহ! তাদের এক এক করে ধ্বংস করুন।’ (অতঃপর তিনি এ কবিতা দুটি আবৃত্তি করলেন)
‘যখন আমি মুসলিম হিসেবে শহীদ হচ্ছি, তখন কোনো ভয় করি না।
আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাকে যেখানেই মাটিতে লুটিয়ে ফেলা হোক না কেন।
আমার এ মৃত্যু আল্লাহর জন্যই হচ্ছে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন,
তবে আমার দেহের প্রতিটি খণ্ডিত জোড়াগুলোয় বরকত সৃষ্টি করে দেবেন।’
অবশেষে হারিসের পুত্র তাঁকে শহীদ করে ফেলে। বস্তুত, যে মুসলিম ব্যক্তিকে বন্দী অবস্থায় শহীদ করা হয়, তার জন্য দুই রাকাত নামাজ আদায়ের এ রীতি খুবাইব (রা.)-ই প্রবর্তন করে গেছেন।
সেদিন আসিম (রা.) শাহাদাত বরণ করেছিলেন, আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছিলেন। সেদিনই আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিগণও তাঁদের সংবাদ ও তাঁদের ওপর যা যা আপতিত হয়েছিল সবই অবহিত করেছিলেন। আর যখন কুরাইশ কাফিরদের এ সংবাদ পৌঁছানো হয় যে আসিম (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছে, তখন তারা তাঁর কাছে এক লোককে পাঠায়, যাতে সে ব্যক্তি তাঁর লাশ হতে কিছু অংশ কেটে নিয়ে আসে, যেন তারা তা দেখে চিনতে পারে। কারণ, বদর যুদ্ধের দিন আসিম (রা.) কুরাইশদের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। আসিমের লাশের (রক্ষার জন্য) মৌমাছির ঝাঁক প্রেরিত হলো যারা তাঁর দেহ আবৃত করে রেখে তাদের ষড়যন্ত্র হতে হেফাজত করল। ফলে তারা তাঁর শরীর হতে এক খণ্ড গোশতও কেটে নিতে পারেনি।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩০৪৫