অগাধ জ্ঞানী লোকমান হাকিম

মাওলানা রুমির মসনবি কাব্যগ্রন্থটি কোরআন–হাদিসের মর্ম উদ্ধারের এক বিশাল ভান্ডার। মাওলানা রুমির মসনবির আলোচনা করতে গিয়ে ফারসি আধ্যাত্মিক কবি মাওলানা আবদুর রহমান জামি বলেছেন, ‘মাসনভিয়ে মা’নাভিয়ে মৌলভি—হাস্তে কোরআন দার যাবানে পাহলাভি,’ অর্থাৎ মওলানা রুমির মসনবি হলো ফারসি ভাষায় আল–কোরআনের ভাষ্য।

লোকমান হাকিম ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে তিনি এমনই সম্মানিত যে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও উপদেশনামা দিয়ে মহাগ্রন্থ আল–কোরআনে সুরা লোকমান নামে একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন। মাওলানা রুমি তাঁর রচিত মসনবি কাব্যগ্রন্থে হজরত লোকমান হাকিমের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার একটি গল্প আলোচনা করেছেন।

হজরত লোকমান হাকিম ছিলেন হালকা–পাতলা কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। যুবক বয়সেই তিনি দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর মালিক তাঁকে অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে বাগানে ফল তোলার কাজ করাতেন। তাঁর সঙ্গে যেসব শ্রমিক কাজ করত, তারা হজরত লোকমানকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারত না। তারা বাগানের ফল তোলা শেষ হলে সেখান থেকে অনেকগুলো ফল খেয়ে মালিকের কাছে হজরত লোকমান হাকিমের নামে বদনাম করত। একদিন তার মালিক দেখতে পেলেন, যে পরিমাণ ফল তার বাগান থেকে তোলা হয়, সে পরিমাণ ফল তার বাসায় এসে পৌঁছায় না। তাই তিনি অন্যদের কথা বিশ্বাস করে হজরত লোকমানকে সন্দেহ করতে লাগলেন।

মালিকের আচরণে হজরত লোকমান তা বুঝতে পেরে মালিককে বললেন, ‘আমি আপনার বাগানের কোনো ফল নষ্ট করি না কিংবা খাই না। আপনি আমাকে যা কিছু প্রদান করেন, তা–ই আমার জন্য হালাল, বাকি সবকিছুকে আমি হারাম মনে করি।’ মালিক তাঁর কথায় তুষ্ট না হওয়ায় তিনি প্রস্তাব দিলেন যে বাগান থেকে ফল তুলে আনার পর আপনি সবাইকে গরম পানি পান করিয়ে মাঠে দৌড়াতে বলবেন, এতে করে কারা অপরাধী, তা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

লোকমান হাকিমের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁর মনিব সবাইকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন বাগানে কাজ শেষে শ্রমিকেরা যখন বাড়ি ফিরে এল, তিনি সবাইকে গরম পানি খেতে দিলেন। মালিকের নির্দেশমতো সবাই গরম পানি খেল। এরপর সবাইকে খোলা মাঠে দৌড়ানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি তাদের পেছনে ঘোড়ায় করে ছুটতে লাগলেন। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর শ্রমিকেরা হাঁপিয়ে উঠে অসুস্থ হয়ে সবাই বমি করে দিল। এতে সবার পেট থেকে আঙুর ও আপেলের টুকরা বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু লোকমান হাকিমের পেট থেকে শুধু পানি বের হলো। এভাবেই তিনি নিজ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মালিকের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করলেন।

হজরত লোকমান হাকিমের জীবনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাকে মাওলানা রুমি বিচার দিনে নিজ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ইঙ্গিত করতে গিয়ে বলেন, চুঁন সাকা মা’য়ে হামিমান ক্বেতআত—জুমলাতুল আসতারে মিম্মা আফজাহাত। অর্থাৎ যখন তাদের জাহান্নামের গরম পানি পান করানো হবে, তখন তাদের শরীরের আবরণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে সব গোপন কথা বলে দেবে। মাওলানা রুমি এভাবেই তাঁর প্রতিটি কবিতায় ধর্মদর্শন ও অধ্যাত্মবাদের দীক্ষা দিয়েছেন।

ড. মোহাম্মদ আবুল বাশার: লেখক