মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের এক শ বছরের কম সময়ের মধ্যে ইসলামের ইতিহাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটি হলো দ্রুতগতিতে আরবের সীমানা ছাড়িয়ে প্রাচ্যে পারস্য হয়ে ভারত এবং পাশ্চাত্যে আফ্রিকা হয়ে স্পেনে ইসলামের প্রসার। অন্যটি হলো মহানবীর উত্তরসূরি হিসেবে ইসলামি শাসনব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রদান নিয়ে শিয়া ও সুন্নি—এই দুটি ধারায় মুসলমানদের বিভক্ত হয়ে পড়া। ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখিকা লেইসলি হ্যাজেলটন তাঁর ‘আফটার দ্য প্রফেট: দ্য এপিক স্টোরি অব দ্য শিয়া-সুন্নি স্প্লিট’ বইয়ে সুন্দরভাবে এই বিভক্তির ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
শিয়াতু আলী বা আলীর দল বা আলীর অনুসারীরা সাধারণভাবে শিয়া নামে পরিচিতি। মুসলিম উম্মাহর এই প্রধান দলটির উদ্ভব ঘটেছিল প্রথমত রাজনৈতিক কারণে। এর সঙ্গে ধর্মীয় তথা আধ্যাত্মিক বিষয় যুক্ত হয়ে মতভেদ প্রবলতর হয়। শিয়াপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে হজরত আলী (রা.) মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত উত্তরসূরি এবং এই ধারাবাহিকতায় হজরত আলীর দুই ছেলে হাসান ও হোসেন ইসলামের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের দাবিদার। কিন্তু অন্যরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁদেরকে এই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বা ইমামত থেকে বঞ্চিত করেছে। অন্যদিকে সুন্নিপন্থীরা মনে করেন যে মহানবী (সা.) তাঁর বংশ পরম্পরার মাধ্যমে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রথা প্রবর্তন করেননি। বরং তিনি কাউকে তাঁর উত্তরসূরি মনোনীত না করে তাঁর নিকটতম সহযোগী বা সাহাবায়ে কেরামসহ তখনকার মুসলমানদেরকেই নিজেদের নেতা নির্বাচনের পথ খুলে রেখে গেছেন। সে কারণেই তাঁর ইন্তেকালের পর সর্বসম্মতিক্রমে হজরত আবু বকর (রা.) প্রথম খলিফা বা ইমাম হয়েছেন। এরপর হজরত উমর (রা.)দ্বিতীয়, হজরত উসমান (রা.) তৃতীয় আর হজরত আলী (রা.) চতুর্থ খলিফা হন।
তবে আলীর (রা.) খিলাফতকালে সিরিয়ার শাসক মুয়াবিয়া বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও কূটচালের মাধ্যমে আলী(রা.)কে কোণঠাসা করে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বকে দ্বিধা বিভক্ত করেন। এরপর খারেজিরা আলী(রা.)কে হত্যা করলে মুয়াবিয়া নিজেকে মুসলিম বিশ্বের শাসক বা খলিফা ঘোষণা করেন। আর মৃত্যুর আগে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করে দামেস্কে উমাইয়া রাজতন্ত্রের সূচনা ঘটান। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে আলীর ছোট ছেলে হোসেন সোচ্চার হলে তাঁকে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী নির্মমভাবে শহীদ করে। আর হোসেনের এই হত্যাকাণ্ড মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরকালের মতো বিভাজন তৈরি করে দেয়।
হ্যাজেলটনের বইটি তিনটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বের নাম ‘মুহাম্মদ’, দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘আলী’ আর তৃতীয় পর্বের নাম ‘হুসেইন’। তিনি মহানবী(সা.) র ইন্তেকালের পর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আলীর (রা.)উত্থান-পতন এবং সবশেষে হুসেইনের হত্যাযজ্ঞ ও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল তুলে ধরেছেনে। তিনি দেখিয়েছেন যে মহানবীর(সা.) সবচেয়ে সক্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা (রা.)কীভাবে মহানবীর কন্যা ফাতিমার (রা.)স্বামী আলীর(রা.) (যিনি মহানবীর চাচাতো ভাইও বটে) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, যা প্রকারান্তরে ইসলামে গৃহযুদ্ধ উসকে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। একাধারে ওই সময়কার রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে লেখিকা বর্তমান সময়ে এসে ভূরাজনীতিতে শিয়া-সুন্নি বিভাজনের মাত্রা ও প্রতিক্রিয়ার ওপরও আলোকপাত করেছেন।
তবে হ্যাজেলটনের বইটিতে শিয়া-সুন্নি বিভাজন তৈরির ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ ইবনু সাবা ও তাঁর সহচরদের ভূমিকা বা কর্মকাণ্ড নিয়ে তেমন কিছু উল্লেখ করেননি, যা বইটির একটি সীমাবদ্ধতা। তিনি আত-তারাবির ‘তারিখ আল-রুসুল ওয়া-আল-মুলুখ’ (নবী-রাসুল ও রাজা-বাদশাদের ইতিহাস) বইটির ২৯ খণ্ডে প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য হিস্টরি অব আত-তারাবি’-কে প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছেন। উত্তেজনাকর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে চীনের মধ্যস্থতায় সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব ও শিয়া নিয়ন্ত্রিত ইরানের মধ্যকার বহু বছরের চলে আসা বিরোধ-বিভাজন কমানোর উদ্যোগ যখন সারা দুনিয়ায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, তখন শিয়া-সুন্নি বিভাজনেরে ইতিহাস জানতে এই বই সহায়ক হবে।
আফটার দ্য প্রফেট: দ্য এপিক স্টোরি অব দ্য শিয়া-সুন্নি স্প্লিট; লেইসলি হ্যাজেলটন; অ্যাংকর বুকস, নিউইয়র্ক, ২০০৯।