আগে থেকেই আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে মাগরিবের নামাজ আদায় করে মিনায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে আর হোটেলেই অবস্থান করতে। সুন্নাহ হলো, ৮ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া। কিন্তু, লাখ লাখ হজযাত্রীকে মিনায় ঠিকঠাক মতো নিয়ে যাওয়ার জন্য ৮ জিলহজ সন্ধ্যার পর থেকেই মক্কার বিভিন্ন জায়গা থেকে মোয়াল্লেম বাসে করে হজযাত্রীদের মিনায় পাঠাতে শুরু করেন। এটাই সৌদি সরকারের নিয়ম।
আমরা মিনার জন্য একটা করে পিঠের থলে আর একটা করে হাতব্যাগ নিয়েছিলাম। পিঠের থলেতে এক সেট ইহরামের কাপড়, এক জোড়া চপ্পল, ছাতা, পানির বোতল, একটা করে গামছা, লুঙ্গি, গেঞ্জি, আর চাদর, ভরে নিলাম। আরও নিলাম মুজদালিফার মাটিতে রাতে বিছিয়ে শোয়ার জন্য একটা পাটি যা মক্কা থেকেই কিনেছিলাম। হাতব্যাগে নিলাম ওষুধপত্র, রুমাল, হজ গাইড, রোদচশমা, মিসওয়াক, পেস্ট-ব্রাশসহ টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস। এগুলো মোটামুটি আগেই গুছিয়ে ফেলেছিলাম। আর কোমরের বেল্টে রাখলাম টাকা ও মোবাইল ফোন।
বাস ঠিক কখন আসবে, তা অবশ্য কেউ বলতে পারছিল না। তবে আমরা ইশার নামাজের আগেই ইহরামের লেবাস পরিধান করে ’লাব্বাইক হজ’ মুখে উচ্চারণ করে ফরজ হজের নিয়ত করলাম। সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। সেলাইবিহীন ইহরামের লেবাস গায়ে চাপানো তথা ইহরাম বাঁধা মানে কাফনের কাপড় গায়ে জড়ানো। এর মানে ইহরাম অবস্থায় সকল হালাল জিনিসও হারাম হয়ে পড়ে। ইহরামের লেবাসে থাকা পুরো সময়টা নিজেকে মুর্দা মনে করলে আল্লাহ জিন্দা হজ দেন। আফসোস! সে রকমটাতো বেশির ভাগ সময়ই মনে করিনি, মনে রাখিনি, মনে রাখতে পারিনি।
ইহরাম বেঁধে আম্মাকে দেশে ফোন করলাম ও দোয়া চাইলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোতে প্রবেশ করতে চলেছি। এ সুযোগও মাত্র একবারই পাওয়া যায়। ওদিকে আমার সহধর্মিণীও নিয়মমাফিক ইহরাম বেঁধে হজের নিয়ত করে ফেলেছে। আমরা এক সাথে দাঁড়িয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে একবার তালবিয়া পাঠ করলাম। এ সময় ওর মুখমণ্ডলে এক বেহেশতী আভা ফুটে উঠতে দেখলাম। হজ পালনের জন্য ও আল্লাহর দরবারে আমার চেয়ে অনেক বেশি কান্নাকাটি করেছে।
দুই.
নবম তলা থেকে লিফটে নিচে নামতে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। ১৮ তলা থেকে শুরু করে সবাই নামছে। কেউ আগে, কেউ পরে। লবিতে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। অনেকেই বারান্দায় ও রাস্তায় নেমে গেছে। বাস আসতে শুরু করার পর একটা হুলুস্থুল দেখা দিল। বলা হয়েছিল যে এভাবে প্রতি বাসে গড়ে ৫০টি আসন থাকলেও সেগুলো পূর্ণ হওয়ার পর আরও ২০/২৫ জন দাঁড়িয়ে যাবেন। বাস এসে থামতে না থামতেই অনেকে হুড়মুড় করে ওঠার চেষ্টা করছেন। তাতে একটা ছোট খাট বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা মাইকে বারবার করে বলেও তা সহজে ঠিক করতে পারছিলেন না।
আমাদের দলের মা-বোনদের আগে ঠিকঠাকমতো বাসে তোলার জন্য তানজীর, আজম এরা খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করল। তবে আমরা কয়েকজন আর সেই বাসে উঠতে পারলাম না। তবে গন্তব্য একই জায়গায়, আর তাঁবু নির্ধারিত। তাই চিন্তার কিছু ছিল না। পরের বাসে আরেকটা গ্রুপের সঙ্গে কিছুটা জোর করেই উঠলাম। তাঁবুর শহর মিনায় পৌঁছাতে ৩০ মিনিটের মতো লাগল।
আমাদের তাঁবু নম্বর ছিল সি-৪। আসলে এ রকম কয়েকটি তাঁবু মিলিয়ে একগুচ্ছ তাঁবুর একটি নম্বর দেওয়া হয়। আমাদের গুচ্ছের নম্বর ছিল ২৫। আর এটি মিনার ৫৬ নম্বর রাস্তায় অবস্থিত। তাই ‘২৫/৫৬’ এভাবে লেখা হয় ও এভাবেই মূল ফটকের সামনে ফলক টাঙানো হয়। আগের রাতেই আমাদের প্রত্যেককে তাঁবু নম্বর সংবলিত হাত বন্ধনী দেওয়া হয় যা পুরো পাঁচ দিন হাতে রাখতে হয়েছে। পাশের তাঁবুতেই ছিল মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা। মিনায় তাঁবুগুলো ভাগ করা হয় মক্তব ভিত্তিতে। আর মক্তবগুলো সৌদি সরকারের অনুমোদিত কয়েকটি কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হয়।
আমরা তাঁবুতে এসে দেখি যে আমাদের দলের আরও অনেকে আগেই এসে পড়েছেন। পাশাপাশি পেতে রাখা একটি খালি বিছানায় আমি উঠলাম। এটা মিনার ’সি’ ক্যাটাগরির তাঁবু যেখানে প্রতিটি বিছানা একজন মানুষ চিৎ হয়ে শোয়ার পর দু পাশে আর কোনো জায়গা থাকে না। কবরে মুর্দাকে শোয়ানোর জন্য যতটুকু জায়গা থাকে, মিনায় বেশির ভাগ হাজির বিছানাও প্রায় ততটুকু জায়গা। বিলাসবহুল তাঁবুর কথা আলাদা।
নারী ও পুরুষদের তাঁবুগুলো পাশাপাশিই থাকে। আমাদের দলের নারীরা যে তাঁবুতে ছিলেন, সেটার দরজার পাশে অমোচনীয় কালি দিয়ে আমি আমাদের গাইডের নাম লিখে দিলাম যেন খুঁজতে সুবিধা হয়।
মিনার তাঁবুগুলো দেখতে সব একরকম। রাস্তা ও তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে খুঁজে বেড় করা অসম্ভব। তাই নম্বরগুলো টুকে রাখতে হয় বা মোবাইল ফোনে ছবি তুলে রাখতে হয়। তবে হাতের কবজিতে থাকা বন্ধনীতেও তাঁবুর নম্বর দেওয়া থাকে। ওটা দেখিয়েও হজ কর্মীদের মাধ্যমে তাঁবুতে পৌঁছানো যায়। হাত বন্ধনীতে তাঁবুর বিস্তারিত বারকোড আকারে দেওয়া থাকে। এ ছাড়া আমাদের ট্রেনের টিকিটও দেওয়া হয়েছিল সবুজ রঙের হাত বন্ধনী আকারে। হজের পুরো পাঁচ দিন ও দুটো হাত বন্ধনী হাতে রাখতে হয়েছে। এগুলো পানি নিরোধক। তাই অজুর সময় ভিজলেও সমস্যা হয় না।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক