হিজরতকারীদের ফেরত আনার জন্য কোরাইশরা আবিসিনিয়ায় লোক পাঠাল: ২

জাফর ইবনে আবু তালিব তখন বললেন, ‘মহারাজ, আমরা অসভ্য লোক ছিলাম। পুতুল পূজা করতাম, মরা জীবজন্তু খেতাম, আমরা জঘন্য কাজ করতাম, স্বাভাবিক সম্পর্কের মর্যাদা রাখতাম না, অতিথিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতাম এবং আমাদের মধ্যে সবলরা দুর্বলদের গিলে খেত। এমনি করে আমাদের দিন কাটছিল। তারপর আল্লাহ্‌ আমাদের কাছে একজন নবী পাঠালেন। তাঁর বংশধারা, সত্যনিষ্ঠা এবং ভদ্রতাবোধ সম্পর্কে আমাদের কোনো সংশয় নেই। তিনি আমাদের আহ্বান জানালেন, আল্লাহ্‌র একত্ব স্বীকার করে নিতে, তাঁর উপাসনা করতে এবং বংশানুক্রমে আমরা যে পাথর ও প্রতিমার পূজা করে আসছি, তা বন্ধ করে দিতে। তিনি আমাদের সত্য কথা বলতে, আমাদের প্রতিজ্ঞা পালন করতে, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ রাখতে এবং অতিথিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাদের অপরাধ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকতে বললেন। জঘন্য কাজ, মিথ্যা কথা বলা, এতিমের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা, সতী নারীর নামে কলঙ্ক আরোপ করতে তিনি নিষেধ করলেন আমাদের।

তিনি আদেশ করলেন এক আল্লাহ্‌র ইবাদত করতে, তাঁর সঙ্গে কাউকে বা কোনো কিছুকে শরিক না করতে। তিনি নামাজ, জাকাত এবং রোজা (ইসলামের শর্ত অনুযায়ী) পালন করতে নির্দেশ দিলেন। আমরা তাঁর সত্যকে স্বীকার করে নিলাম, তাঁর ওপর ইমান আনলাম। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তিনি যা এনেছেন, সবকিছু আমরা অনুসরণ করতে শুরু করলাম। আমরা আল্লাহ্‌র সঙ্গে কোনো শরিক না করে তাঁর ইবাদত শুরু করলাম। তিনি যা নিষেধ করলেন, তাকে আমরা হারাম বলে জানলাম। তিনি যা হালাল করলেন, তাকেই আমরা হালাল বলে জানলাম। এতেই আমাদের লোকজন আমাদের আক্রমণ করল, আমাদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করল, আমাদের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে আল্লাহ্‌র উপাসনা ছেড়ে তাদের পৌত্তলিকতায় ফিরে যেতে প্ররোচিত করল, আমরা একসময় যেসব মন্দ কাজ করতাম, তা হালাল বলে গ্রহণ করার জন্য আমাদের প্ররোচিত করতে লাগল। সুযোগ পেলেই তারা যখন আমাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করতে শুরু করল, আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলল, আমাদের ধর্ম তুলে কথা বলতে শুরু করল, তখন আমরা আপনার দেশে চলে আসি, কারণ অন্য সমস্ত রাজার চেয়ে আপনার ওপর আমাদের আস্থা বেশি। আপনার আশ্রয়ে আমরা এখানে সুখে আছি, আমরা বিশ্বাস করি মহারাজ, যত দিন আমরা আপনার কাছে থাকব, তত দিন আমাদের ওপর কোনো অন্যায় আপনি হতে দেবেন না।’

নিগাস জিজ্ঞেস করলেন, তাঁদের কাছে ঐশী কোনো কিছু আছে কি না। জাফর বললেন, আছে। নিগাস হুকুম করলেন সে জিনিস তাঁকে পাঠ করে শোনাতে। তখন জাফর সুরা কাফ-হা-ইয়া-আইন-সাদ থেকে পাঠ করে শোনালেন। তাঁর সেই পাঠ শুনে অশ্রুতে দাঁড়ি সিক্ত হলো রাজার, পুরোহিতদের হাতের গ্রন্থ ভিজে গেল। তারপর নিগাস বললেন, ‘এটি আর ঈসা যা এনেছিলেন, তা একই সত্যের অংশ, তা একই উৎস থেকে এসেছে। তোমরা দুজন এখন যেতে পারো। আল্লাহ্‌র কসম, ওঁদের আমরা কোনো দিন তাদের হাতে ছাড়ব না, তাঁদের প্রতি কোনো দিন বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না।’

ওরা দুজন চলে গেল। আমর বলল, ‘কাল আমি তাকে এমন এক কথা বলব, ওদের সবার ভিত নড়ে যাবে।’ এদের মধ্যে আবদুল্লাহ্‌ ছিল একটু ধর্মভীরু। সে বলল, ‘তা করো না, ওরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে সত্য কিন্তু তবু ওরা আমাদের আত্মীয় তো!’ আমর বলল, ‘ঈশ্বরের শপথ, আমি তাকে বলব যে ওরা বলে মরিয়মের ছেলে ঈসা একটা সৃষ্ট জীব।’

ভোরবেলা সে রাজার কাছে গেল, বলল, তারা মরিয়মের ছেলে ঈসা (আ.) সম্পর্কে ভয়ানক এক কথা বলেছে, কাজেই তাঁর উচিত তাঁদের ডেকে জিজ্ঞেস করা। তিনি তা-ই করলেন। ওঁদের জীবনে এমন ঘটনা আর কোনো দিন ঘটেনি। সবাই জড়ো হয়ে একে অপরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন—ঈসা (আ.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কী তাঁরা বলবেন। তাঁরা ঠিক করলেন, আল্লাহ্‌ যা বলেছেন এবং রাসুল (সা.) যা এনেছেন, তা-ই তাঁরা বলবেন। তাতে যা হওয়ার তা হবে। তাঁরা রাজদরবারে হাজির হলেন। রাজা যখন সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, তখন জাফর জবাব দিলেন, ‘তাঁর সম্পর্কে আমাদের নবী যে প্রত্যাদেশ পেয়েছেন, তা-ই আমরা বলি। প্রত্যাদেশ হয়েছে, তিনি (ঈসা) আল্লাহ্‌র দাস এবং তাঁর নবী এবং তাঁর আত্মা, এবং তাঁর বাক্য যা তিনি আশীর্বাদপুষ্ট কুমারী মরিয়মের ভেতরে প্রবিষ্ট করিয়েছিলেন।’

নিগাস তখন মাটি থেকে একটা দণ্ড তুলে নিলেন। বললেন, ‘ঈশ্বরের শপথ! তোমরা যা যা বললে মরিয়মের ছেলে ঈসা তার চেয়ে এই দণ্ড পরিমাণও বেশি নন।’ সে কথা শুনে উপস্থিত সভাসদেরা ফোঁস ফোঁস করে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা ফোঁস করো আর যা-ই করো, ঈশ্বরের শপথ, আমি যা বলেছি বলেছি। তোমরা যাও, তোমরা আমার রাজ্যে নিরাপদ।’ তারপর তিনি তিনবার বললেন, ‘যে তোমাদের অভিসম্পাত দেবে, তাকে জরিমানা করা হবে। এক পাহাড় স্বর্ণ দিলেও কাউকে আমি তোমাদের আঘাত করতে দেব না। ওদের উপঢৌকন ওদের কাছে ফিরিয়ে দাও; ওসবে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর যখন আমাকে আমার রাজ্য প্রত্যর্পণ করেন, তখন আমার কাছ থেকে কোনো ঘুষ নেননি। তাহলে আমিও নেব না। মানুষ আমার যা করতে চাইছিল, ঈশ্বর আমার তা করেননি। কাজেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষ আমাকে যা করতে বলছে, আমিই বা তা করব কেন।’ সুতরাং মর্মাহত ওরা সব চলে গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল প্রত্যাখ্যাত উপঢৌকনরাজি। আমরা রয়ে গেলাম তাঁর সঙ্গে, পরম সুখে নিরাপদে।

এমনই করে আমাদের দিন কাটছিল। তখন হঠাৎ এক বিদ্রোহী নিগাসের সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হলো। আমরা এত বিষণ্ণ জীবনে আর হইনি। আমাদের উদ্বেগ ছিল, এই বিদ্রোহী না আবার নিগাসকে কাবু করে ফেলে; কারণ নিগাস আমাদের কথা যত জানতেন, সে লোক তত জানত না। নিগাস তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। দুই তীরে দুই বিবদমান পক্ষ, মধ্যখানে নীলনদ। রাসুলে করিমের (সা.) সাহাবিরা এমন কাউকে খুঁজছিলেন যে অকুস্থলে গিয়ে যুদ্ধের খবর নিয়ে আসবে। আল-জুবায়ের ইবনে আল-আওয়াম নিজে থেকে যেতে চাইল। সে-ই ছিল আমাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ব্যক্তি। পানির একটা ভিস্তি ফেলানো হলো, সেটা বুকের নিচে বেঁধে সে নীলের বুকে ঝাঁপ দিল। সাঁতরাতে সাঁতরাতে সে গেল সেই যুদ্ধস্থলে, যেখানে দুই পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন। আরও এগিয়ে গেল সে। ওদের সামনে গিয়ে হাজির একেবারে। ইতিমধ্যে আমরা প্রার্থনা করছিলাম আল্লাহ্‌র কাছে শত্রুদের বিরুদ্ধে নিগাসকে জয়ী করার জন্য। আপন রাজ্যে তাঁর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য। প্রার্থনা করছিলাম আর কী ঘটে না-ঘটে অপেক্ষা করছিলাম। তখনই আমরা দেখলাম ছুটে আসছে আল-জুবায়ের। দুই হাতে ওড়াচ্ছে কাপড়, চিৎকার করে বলছে, ‘শুনছ, তোমরা শোনো, নিগাস জয়লাভ করেছে, আল্লাহ্‌ তাঁর দুশমনদের নিকাশ করে দিয়েছেন, আপন রাজ্যে তাঁর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ আল্লাহ্‌র কসম, আমরা জীবনে এমন আনন্দিত আর কোনো দিন হইনি। ফিরে এলেন নিগাস, আল্লাহ্‌ ধ্বংস করেছেন তাঁর দুশমনদের, রাজ্য তাঁর টিকে রইল, আবিসিনিয়ার দলপতিরা তাঁকে সমর্থন জানাল। আমরা পরম আনন্দে দিন কাটাতে লাগলাম। তারপর একদিন আমরা মক্কায় গেলাম আমাদের রাসুলে করিমের (সা.) কাছে।

অনুবাদ: শহীদ আখন্দ

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে