এ কথার পর রাসুলে করিম (সা.) ওখান থেকে উঠে চলে গেলেন। তাঁর ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন আবদুল্লাহ্, ইবনে আবু উমাইয়া ইবনে আল-মুগিরা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর ইবনে মাখজাম (তিনি তাঁর চাচি আতিকা বিনতে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে) বললেন, ‘শোনো মুহাম্মদ, তোমার জ্ঞাতিগোষ্ঠী তোমার কাছে কতগুলো প্রস্তাব দিল, তুমি তার একটাও রাখলে না। প্রথমে তারা নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে কিছু জিনিস জানতে চাইল। তোমার দাবি অনুযায়ী আল্লাহ্র সাথে তোমার সম্পর্কটা জানা ছিল যাদের উদ্দেশ্য। ওটা জানতে পারলে তোমার কথার ওপর তাদের ইমান আনা সহজ হতো। তুমি কিছুই করলে না। তারপর তারা প্রস্তাব দিল, তোমার নিজের স্বার্থের অনুকূলে কয়েকটি কাজ করার জন্য, তাতে করে তারা বুঝতে পারত তুমি তাদের চেয়ে বড়। আল্লাহ্র সঙ্গে তোমার সম্পর্কটাও তাদের কাছে পরিষ্কার হতো।
সেটাও তুমি করোনি। তারপর তারা তাদের ওপর কতগুলো শাস্তি আরোপ করার জন্য অনুরোধ জানাল, যে শাস্তির ভয় তুমি তাদের দেখাচ্ছ। তা-ও তুমি করোনি।’ হুবহু এই সংলাপ নয়, তাঁর বক্তব্য ছিল এই। তিনি আরও বললেন, ‘আল্লাহ্র কসম, তুমি যদি আসমানে একটা মই লাগাও, তা বেয়ে ওঠো, আমি নিজের চোখে দেখি, যতক্ষণ না তোমার ফেরেশতারা তোমার সঙ্গে এসে সাক্ষ্য দেয় তুমি যা বলছ তা সব সত্য, ততক্ষণ আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব না। আল্লাহ্র কসম, যা যা বললাম, তা যদি করো তাহলেও তোমার কথা বিশ্বাস করা আমার উচিত হবে বলে মনে হয় না।’
কথাগুলো বলেই আবদুল্লাহ্ চলে গেলেন।
রাসুলে করিম (সা.)-ও ফিরলেন আপন ঘরে। বিষণ্ন, আহত। আশা করে দৌড়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁর নসিহতে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করবেন। গিয়ে দেখলেন সে আশা বৃথা। দেখলেন, তাঁরা তাঁর প্রতি বৈরী।
রাসুলে করিম (সা.) চলে গেলে পরে প্রথমে কথা বলল আবু জেহেল। তার বিরুদ্ধে সেই পুরোনো অভিযোগগুলো উচ্চারণ করল। বলল, ‘আল্লাহ্কে সাক্ষী মেনে আমি বলছি, কালকে আমি তার জন্য পথ চেয়ে থাকব, আমার হাতে থাকবে বিরাট এক পাথর, পাথরটাকে সর্বশক্তি দিয়ে কোনোমতে তুলে রাখব। ও যখন নামাজে, সেজদা দেবে, আমি ওই পাথর মেরে ওর মাথার খুলি গুঁড়া করে ফেলব। আমাকে তোমরা রাখো আর মারো যা-ই করো, এরপর বনু আবদু মানাফ করুক আমাকে যা করতে পারে।’ এই ছিল আবু জেহেলের বক্তব্য।
সবাই বলল, কেউ তাকে মারবে না, কেউ বেইমানি করবে না যে যা করবে বলেছে, তা করতে পারে।
পরদিন ভোর হলো। পাথর নিয়ে আবু জেহেল বসে আছে নবী করিমের (সা.) আসার পথে, তাঁর প্রতীক্ষায়। প্রতিদিনের মতো সেই সকালেও নবী করিম (সা.) নামাজে গেলেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন। নামাজ পড়তেন দক্ষিণ কোণ ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে। তাতে করে কাবা থাকত তাঁর এবং সিরিয়ার মাঝখানে। নামাজ পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন নবী করিম (সা.)। কোরাইশরা তখন বসে আছে আবু জেহেল কী করে দেখবে বলে। সেজদায় গেলেন রাসুলে করিম (সা.)। পাথর ওঠাল আবু জেহেল, এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। তাঁর কাছে এসে গেল এবং ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ পেছন ফিরে পালিয়ে এল সে, ভয়ে রক্তহীন মুখ পাথরের সঙ্গে লেগে শুকিয়ে গেছে তার হাত, পাথর ছিটকে পড়ে গেছে তার হাত থেকে।
কোরাইশরা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। সে জবাব দিল যে তার কাছে যেতেই একটা মর্দা উট তার পথ রুখে দাঁড়াল। বলল, ‘ইয়া আল্লাহ্, উটের এমন মাথা, এমন কাঁধ, এমন দাঁত আমি আর দেখিনি, আর এমন ভাব করল, মনে হলো আমাকে খেয়ে ফেলবে।’
আমাকে একজন বলেছে, রাসুলে করিম (সা.) বলেছিলেন, ‘উনি ছিলেন জিবরাইল (আ.)। ও কাছে এলেই তাকে তিনি ধরতেন।’
আবু জেহেলের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল আল-নজর ইবনে আল-হারিস ইবনে কালাদা ইবনে আল-কামা ইবনে আবদু মানাফ ইবনে আবদুদ দার ইবনে কুসায়ি। বলল, ‘হে কোরাইশগণ, তোমাদের সামনে এখন যে সমস্যা তার সমাধান তোমরা জানো না। মুহাম্মদ যখন যুবক ছিল, তোমরা সবাই তাকে ভালোবাসতে। তোমাদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে সত্যবাদী, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তারপর যখন তোমরা দেখলে ওর মাথার চুলে পাক ধরল, সে তোমাদের কাছে এক বার্তা নিয়ে এল, তখন তোমরা বললে ও একজন জাদুকর। কিন্তু জাদুকর সে নয়। কারণ, জাদুকর কী জিনিস আমরা তা জানি, আমরা তাদের থুতু, গেরো সব দেখেছি। তোমরা বললে, সে একজন স্বর্গীয় লোক, কিন্তু আমরা সেরকম লোকও দেখেছি এর আগে, তাদের ব্যবহার আচার-আচরণ দেখেছি, শুনেছি তাদের ছন্দমিলের কবিতা। তোমরা বললে, ও একজন কবি। কিন্তু ও তো কবি নয় মোটেই, কারণ আমরা সব জাতের কবিতা আগে শুনেছি। তোমরা বললে, ওকে ভূতে ধরেছে। কিন্তু ও তো ভূতে ধরা মানুষের মতো বড় বড় দম নেয় না, ফিসফিস করে কথা বলে না, আবোলতাবোল বলে না। কোরাইশ বংশের সবাইকে বলছি, তোমাদের বিষয় তোমরা বুঝে নাও, কারণ আল্লাহ্র কসম। তোমাদের ওপর সমূহ বিপদ নাজিল হয়েছে।’
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে