আরবের গোত্রগুলোতে কবি হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল

রাসুল (সা.) হুনাইন যুদ্ধ শেষ করে তায়েফের দিকে যাত্রা করার সময় হজরত কাব ইবনে মালিক (রা.) দুটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি দাউস গোত্রের ওপর এত প্রভাব ফেলে যে তারা তা শুনেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

কাব (রা.) ছিলেন তাঁর সময়ের একজন উত্তম কবি। জাহেলি যুগেই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আরবের গোত্রগুলোতে কবি হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল।

কাব (রা.)-এর বর্ণনা করা হাদিসের সংখ্যা ৮০। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এর সেবায় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে কলম নিয়ে যেমন ভাষার যুদ্ধ করেছেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে তেমনই হাতে তলোয়ারও তুলে নিয়েছেন।

কাব ইবনে মালিক (রা.) ছিলেন আনসার সাহাবি। সততা ছিল তাঁর চরিত্রের একান্ত বৈশিষ্ট্য। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি সত্য বলতে কুণ্ঠিত হতেন না।

কাব (রা.) তাঁর কবিতায় কুরাইশদের যুদ্ধবিগ্রহ ও অতীত ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের দোষত্রুটি তুলে ধরতেন। কবিতার মাধ্যমে একদিকে অবিশ্বাসীদের মনে ভীতির সৃষ্টি করতেন, অন্যদিকে মুসলমানদের মন প্রশান্তিতে পূর্ণ করে দিতেন।

কাব (রা.) কবিতা লিখে রাসুল (সা.)-কে শোনাতেন। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাতে কিছু শব্দ রদবদলেরও পরামর্শ দিতেন। কাব (রা.) সানন্দে তা গ্রহণ করতেন।

কাব (রা.) বদর ও ওহুদ যুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বহু কবিতা লিখেছেন। ওহুদ যুদ্ধের অন্যতম শহীদ রাসুল (সা.)-এর চাচা হামজা (রা.)-এর স্মরণে তিনি একাধিক কবিতা লেখেন। মুতার যুদ্ধের শহীদদের উদ্দেশেও তিনি রচনা করেছিলেন কাসিদা। খন্দক যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর নিন্দা করে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন তিনি।

ওহুদের ময়দানে এই কবি সাহাবি বীরের মতো যুদ্ধ করেন। খন্দকসহ অন্যান্য যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন। মক্কা বিজয়ের সময় ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে।

প্রথম হিজরির রজব মাসে রাসুল (সা.) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেটা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ-অভিযান। যুদ্ধ ছিল রোমান বাহিনীর সঙ্গে। সাজসরঞ্জাম, সংখ্যা ও শক্তিতে বাহিনীটি ছিল বিশ্বসেরা।

সাহাবিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। কাব (রা.) যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দুটি উট প্রস্তুত করলেন। মদিনা এবং এর আশপাশের এলাকার সাহাবিদের নিয়ে রাসুল (সা.) বেরিয়ে পড়লেন তাবুকের উদ্দেশে।

প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গরমে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার ভয়ে নানা অযথা অজুহাত দেখিয়ে বহু সক্ষম মুসলমান সে যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থেকেছে। তবে ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও কাব (রা.) সে যুদ্ধে যেতে পারেননি।

কেন যাননি, কাব (রা.) বিস্তারিতভাবে তা নিজেই বলেছেন। বৃদ্ধ বয়সে একদিন তিনি তাঁর ছেলে আবদুল্লাহর হাত ধরে হাঁটছিলেন।

আবদুল্লাহকে তখন ঘটনাটি কাব (রা.) শোনান—

তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে যখন মুসলমানদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হতো, তখন আমি ভাবতাম, (আমিও) যুদ্ধের প্রস্তুতি নেব। যুদ্ধের জন্য আমি দুটি উটও প্রস্তুত করেছিলাম। বাড়ি ফিরে এলে আমাকে আলস্য পেয়ে বসত। মনে হতো, এত তাড়াহুড়া কিসের? রওনা দেওয়ার সময় যখন হবে, তৈরি হতে কতটুকুই-বা আর সময় লাগবে? এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে যেতে থাকল।

একদিন সেনাবাহিনীর রওনা দেওয়ার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরি নই। মনে মনে ভাবলাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি দুয়েক দিন পর তাদের সঙ্গে যোগ দেব। (এরপর) প্রতিদিন আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। ভাবতাম, বের হব। কিন্তু একটু পরই আবার থেমে যেতাম। অসম্ভব আলসেমি লাগত। আলস৵ই আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়াল। এভাবে সময় পার হয়ে গেল। মদিনায় খবর এল, রাসুল (সা.) তাবুক পৌঁছে গেছেন।

শেষ অবধি আমি মদিনাতেই থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মন ক্রমে বিষিয়ে উঠছিল। কারণ, আমি দেখতে পেলাম, যাদের সঙ্গে আমি এ শহরে রয়েছি, তারা হয় প্রতারক; নয় দুর্বল, বৃদ্ধ ও অক্ষম, আল্লাহ যাদের যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

আমার ভালো লাগত না। সুস্থ, সবল ও সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কেন যে আমি পেছনে থেকে গেলাম, এ অনুশোচনা সারাক্ষণ আমাকে দগ্ধ করত।

রাসুল (সা.) তাবুক থেকে মদিনায় ফিরলেন। রোমানদের সঙ্গে মুসলিমদের কোনো মারাত্মক সংঘর্ষ হলো না। উত্তর আরবের অনেক গোত্র জিজিয়ার বিনিময়ে সন্ধি করেছিল।

রাসুল (সা.) মসজিদে লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য বসলেন। প্রতারকেরা এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের অজুহাত পেশ করতে লাগল। তারা ছিল ৮০ জনের বেশি। রাসুল (সা.) প্রত্যেকের সাজানো কথা শুনলেন। তাদের লোকদেখানো অজুহাত মেনে নিয়ে অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন।”

এরপর আমার পালা এল। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘যুদ্ধে কেন যাওনি?’

আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম, আসলে বলার মতো কোনো অজুহাতই আমার কাছে নেই। আমি যুদ্ধে যাওয়ার মতো সম্পূর্ণ সক্ষম ছিলাম।’

রাসুল (সা.) শুনে বললেন, ‘তুমি সত্য বলেছ। ঠিক আছে, যাও। দেখা যাক, আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত দেন।’

আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে বসলাম। সবাই আমাকে তিরস্কার করে বলতে লাগল, ‘তুমিও কেন অন্যদের মতো বানানো অজুহাত পেশ করলে না?’

আমি জানতে পারলাম, আমার মতো আরও দুজন সত্য কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন মুরারা ইবনে রাবি ও হিলাল ইবনে উমাইয়া। তাঁদের মন খুবই ভালো।

এরপর রাসুল (সা.) হুকুম জারি করলেন, আমাদের তিনজনের সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারবে না। ৫০ দিন পর্যন্ত এ হুকুম জারি থাকবে।

অন্য দুজন ঘরে বসে থাকতেন। দিনরাত তাঁরা শুধু কাঁদতেন। আমি বাইরে বের হয়ে জামাতে নামাজ পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। তবে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না। মনে হতো, দেশ একদম বদলে গেছে। আমি যেন এখানে এক অচেনা মুসাফির। এই জনপদের কেউ আমাকে চেনে না।

মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে রাসুল (সা.)-কে আমি সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁট নড়ছে কি না, দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। অপেক্ষা করাই সার হতো। তাঁর নজর আমার ওপর কীভাবে পড়ছে, তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে যতক্ষণ আমি নামাজ পড়তাম, ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন। যেই আমি নামাজ শেষ করতাম, অমনি আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন।

একদিন আমি আমার চাচাতো ভাই ও বন্ধু আবু কাতাদাহর কাছে গিয়ে তাকে সালাম দিলাম। সে-ও আমার সালামের জবাব দিল না। আমি বললাম, ‘হে আবু কাতাদাহ, আমি আল্লাহর কসম খেয়ে জিজ্ঞাসা করছি, বলো, আমি কি আল্লাহ আর তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি না?’ সে উত্তর দিল না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম। সে চুপ করে থাকল। তৃতীয়বার আমি যখন তাকে আবারও এ প্রশ্ন করলাম, সে শুধু এতটুকু বলল, ‘আল্লাহ আর তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।’ এ কথায় আমার চোখে পানি চলে এল। আমার মনে হচ্ছিল, আমার ইমান নিয়ে সাক্ষী দেওয়ার কেউ নেই।

এ রকমই কোনো এক সময়ে একদিন আমি বাজারে যাচ্ছি। সিরিয়ার নাবতি বংশের এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। সে আমাকে লেখা রেশমে মোড়া গাসসান রাজার একটি চিঠি আমার হাতে দিল। চিঠিটি খুলে পড়লাম। তাতে লেখা, ‘আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার প্রতি খুব উৎপীড়ন করছেন। তুমি তো কোনো সাধারণ ব্যক্তি নও। তুমি আমাদের কাছে চলে আসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দেব।’ চিঠিটি পড়ে আমি বললাম, এ তো আরেক বিপদ। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিঠিটি চুলার আগুনে ফেলে দিলাম।

৪০ দিন এভাবে কেটে গেল। এরপর রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি আমার কাছে এসে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি তোমার স্ত্রীর কাছ থেকেও আলাদা হয়ে যাবে।’

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি কি ওকে তালাক দিয়ে দেব?’ জবাব এল, না, তালাক নয়, শুধু আলাদা থাকবে।

আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘তুমি তোমার মা-বাবার কাছে চলে যাও। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত সেখানেই থাকো।’

এভাবে ৪৯ দিন পার হয়ে ৫০ দিনে পড়ল। ৫০তম দিন সকালে নামাজের পর আমি বাসার ছাদে বসে ছিলাম। নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আসমান-জমিন আমার জন্য ছোট হয়ে এসেছে।

এ সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলল, ‘কাব ইবনে মালিক, তোমাকে মোবারকবাদ!’

আমি বুঝতে পারলাম, আমার দোয়া আর তওবা কবুল হয়েছে। আমার ক্ষমার ঘোষণা জারি হয়েছে। আমি সিজদায় পড়লাম।

ইতিমধ্যে খবরটি মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর আমার বাসার দিকে দলে দলে মানুষ ছুটে এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল।

আমি উঠে সোজা মসজিদে নববির দিকে ছুটে গেলাম। দেখি, রাসুল (সা.) সাহাবিদের মধ্যে বসে আছেন। সেখানে ঢুকতেই তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি দেখতে পেলাম, রাসুল (সা.)-এর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, ‘তোমাকে অভিনন্দন। আজ তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন।’

আমি বললাম, ‘আপনি কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন।’ এই বলে তিনি সদ্য নাজিল হওয়া আয়াত পড়ে শোনালেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ করলেন নবীর ওপর, আর মুহাজির ও আনসারদের ওপর, যারা সংকটের সময় তাঁর (মুহাম্মদের) সঙ্গে গিয়েছিল, এমনকি যখন এক দলের মনের বিকার হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তখনো। পরে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করলেন। তিনি তো ওদের ব্যাপারে ছিলেন দয়াপরবশ পরম দয়ালু।

‘আর তিনি অন্য তিনজনকেও (কাব ইবনে মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা ইবনে রুবাই) ক্ষমা করলেন, যাদের পেছনে ফেলে আসা হয়েছিল। পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা ছোট হয়ে আসছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে আল্লাহ ছাড়া কোনো আশ্রয় নেই। পরে আল্লাহ তাদের অনুগ্রহ করলেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয়। আল্লাহ তো ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৭-১১৮)

তিলাওয়াত শেষ হলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘আমি আমার সব ধনসম্পদ আল্লাহর পথে সদকা করে দিতে চাই। এটাও আমার তওবার অংশ। রাসুল (সা.) বললেন, ‘সব নয়। কিছু রেখে দাও। এটাই তোমার জন্য ভালো।’ এরপর আমি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন, তার ওপর আমি সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকব। আল্লাহর কসম। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোনো দিন মিথ্যার আশ্রয় নিইনি।

কী একটা কঠিন পরীক্ষা যে এসেছিল কাব (রা.)-এর জীবনে। শাস্তির তীব্রতায় কাব (রা.) অস্থির হয়ে পড়ছিলেন, তবু রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য থেকে একটুও টলেননি। শাস্তির পুরো ৫০ দিন কাব (রা.)-এর চোখ সবচেয়ে বেশি অধীর হয়ে খুঁজছিল রাসুল (সা.)-এর মমতাভরা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।