নবীজি (সা.)-এর হাসি

হাসি ও আনন্দ মানুষের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে দেয়। নবীজির (সা.)হাসিখুশির ভঙ্গিও ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের খুবই জরুরি অনুষঙ্গ। এ সম্পর্কিত হাদিসগুলো খণ্ডিত হলেও একেবারে অপ্রতুল নয়।

মহানবী (সা.)-এর আনন্দ তাঁর চেহারায় প্রকাশ পেতো। সাহাবিদের অনেকেই তাঁর আনন্দের টুকরো টুকরো ছবি তুলে ধরেছেন।

 আনন্দের প্রকাশ

মহানবী (সা.)-এর আনন্দ প্রকাশের ধরন নিয়ে দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়।

সিরাত পাঠকমাত্রই কাব ইবনে মালেকের (রা.) ঘটনা সম্পর্কে জানেন। তাবুক যুদ্ধে শরিক না থাকায় তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। পরে যখন আল্লাহ তাঁর তাওবা কবুল করেন। সে সময়ে নবীজির অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, আমি নবীজিকে সালাম দিলাম, আনন্দে তাঁর চেহারা ঝলমল করছিল। তিনি বললেন, ইতোমধ্যে তোমার কেটে যাওয়া জীবনের ওপর সুসংবাদ গ্রহণ করো...। (বুখারি, হাদিস: ৪৪১৮)

কাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আনন্দিত হলে তাঁর চেহারা এমন আলোকিত হয় মনে হয় যেন এক টুকরো দীপ্তিমান চাঁদ। দেখামাত্রই আমরা তাঁর আনন্দ বুঝতে পারতাম। (বুখারি, হাদিস: ৪১৪১)

ইফকের ঘটনার পরে আয়েশা (রা.) নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় নবীজির এমন আনন্দমুখ দেখতে পাওয়া যায়। আয়েশা (রা.) বলেছেন, কুরআন অবতীর্ণ হলে তিনি মাথা তুললেন। তাঁর চেহারায় আনন্দ উথলে উঠতে দেখলাম। তিনি হাত দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে বললেন, আয়েশা, সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহ তোমার নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। (বুখারি, হাদিস: ৬০৯২)

মুচকি হাসি

নবীজি (সা.)–কে আল্লাহ অসামান্য প্রভাব বিস্তার করার যে ক্ষমতা দান করেছিলেন, সেটির সঙ্গে তাঁর হাসি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে কখনো এমনভাবে হাসতে দেখিনি যাতে তাঁর মুখের আলজিভ দেখা যায়। তিনি বরং সবসময় মুচকি হাসতেন। (মুসলিম, হাদিস: ৪১৯)

অর্থাৎ, তিনি সংযম রেখে হাসতেন। নবী-জীবনের শেষ একটি মুহূর্তের বিবরণ তুলে ধরে আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাঁর কক্ষের পর্দা সরালেন। তারপর সাহাবিদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারা নামাজ পড়ছে। তার চেহারা মনে হলো যেন বইয়ের সাদা পাতার মতো। তিনি মুচকি হাসলেন। (মুসলিম, হাদিস: ২৩২২)

নবীজির(সা.) সঙ্গে সাহাবিদের মজলিসের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, সাহাবিরা জাহেলি যুগের আলোচনা করে সশব্দে হাসতেন। কিন্তু রাসুল (সা.) কেবল মৃদু হাসতেন। (বুখারি, হাদিস: ১৯৩৬)

এই বর্ণনা থেকে জানা যায়, বিরোধী পক্ষের সমালোচনার সময়ও নবীজি (সা.) তাঁর সংযম হারাতেন না।

হাসিতে দাঁত দেখতে পাওয়া

হাসার সময় রাসুল (সা.)–এর দু পাশের দাঁত প্রকাশ পেত না বলেই জানা যায়।

একটি ঘটনায় দেখা যায়, রমজান মাসে এক ব্যক্তি স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)তাঁকে এক ঝুড়ি খেজুর দিয়ে বললেন, এগুলো সদকা করে দাও। সে বলল, আমার চেয়ে গরিব কাউকে দেব? খোদার কসম, মদিনায় আমার চেয়ে গরিব কোনো পরিবার নেই। শুনে রাসুল (সা.) এমনভাবে হেসে দিলেন যে, তার দু পাশের দাঁত দেখা গেল। (জাদুল মায়াদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮২)

এই হাদিসে হাসির বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, হাসলে সাধারণত নবীজির (সা.) দু পাশের দাঁত দেখা যেত না।

হাসির বৈশিষ্ট্য

ইবনুল কাইয়িম (র.) বলেন, নবীজির (সা.)হাসি ছিলো মুচকি হাসি। তিনি সাধারণভাবেই মৃদু হাসতেন। হাসিতে দুই পাশের দাঁত দেখার ঘটনা ছিল স্বল্প। তিনি কেবল মুগ্ধ হলেই হাসতেন। নবীজির (সা.)অট্টহাসি দেওয়ার কোনো বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৫০৪)

নবীজি (সা.)সবসময় হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও প্রশস্ত হৃদয় নিয়ে মানুষকে স্বাগত জানাতেন। এমনকি এ কারণে প্রত্যেক সাহাবি ভাবতেন, তিনিই নবীজির (সা.)সবচেয়ে প্রিয়। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর যখনই আমি তার কাছে যেতাম, তিনি আমাকে দেখলেই তিনি চেহারায় মুচকি হাসি ছড়িয়ে দিতেন। (বুখারি, হাদিস: ৩০৩৫)

আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রা.) বলেছেন, আমি কাউকে নবীজির (সা.)চেয়ে বেশি হাসিখুশি দেখিনি। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৮২১)

হাসির নির্দেশনা

হাসিমুখে কথা বলা কেবল সামাজিক শিষ্টাচারই নয়, এর বিনিময়ে মুসলমানের জন্য সওয়াবও রয়েছে। আবু যর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) আমাকে বলেছেন, কোনো সৎকাজকে তুচ্ছ মনে কোরো না, যদি তা তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাতের মতো বিষয়ও হয়ে থাকে। তোমার ভাইয়ের সামনে তোমার মুচকি হাসিও সদকা। (মুসলিম, হাদিস: ২৬২৬)

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)বলেছেন, সকল নেক কাজ সদকা। তোমার কোনো ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি নেক কাজ। (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৫৬)

মানুষ মাঝেমধ্যে কারণ ছাড়াও হাসে। নবীজি (সা.) অকারণে অধিক হাসতে নিরুৎসাহিত করেছেন। আবু হোরায়রা (রা.)–র বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা বেশি হেসো না। কেননা, বেশি হাসি অন্তরকে নির্জীব করে দেয়। (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭০)