চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো শাবান। শাবান মাস বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের দেড় বছর পর পূর্বতন কিবলা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’–এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম তথা খানায়ে কাবা তথা বাইতুল্লাহ শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই।
তাই শাবান মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামি ঐক্যের মাস, অন্যদিকে তেমনি কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।
শাবান মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’, যার অর্থ—মহান শাবান মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত, নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ ইত্যাদি আদায় করতেন। রজব মাসে ইবাদতের মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণ করা, শাবান মাসে আরও বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিতে বীজ বপন করা; রমজান মাসে সর্বাধিক ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে সফলতার ফসল তোলা।
প্রিয় নবী রহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনাসংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য রহমত কামনা করেন; হে বিশ্বাসী মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সুরা-৩৩ আহযাব, আয়াত: ৫৬)
তাই শাবান মাস হলো নবীজির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভক্তি ও প্রেম–ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হবে সুন্নত অনুশীলনের মাধ্যমে।
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, “হে বৎস! যদি পারো এভাবে সকাল ও সন্ধ্যা পার করো যেন তোমার অন্তরে কারও প্রতি হিংসা না থাকে; তবে তা–ই করো।” অতঃপর বললেন, “হে বৎস! এটাই আমার সুন্নত সুমহান আদর্শ। যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অনুসরণ করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসল; যে আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।”’ (তিরমিজি শরিফ: ২৬২৭)
শাবান মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির–আজকার, তাসবিহ তাহলিল, দোয়া কালাম, দান–সদকাহ–খয়রাত, উমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এ মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমাদান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ,১: ২৫৯, শুআবুল ইমান, বায়হাকি,৩: ৩৭৫)
১৪ শাবান দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। এ রাতে ইবাদত করা ও দিনে রোজা রাখা সুন্নত।
বছরব্যাপী প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা সুন্নত। চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদে’র সুন্নত রোজাও রয়েছে। মাসের ১, ১০, ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখ রয়েছে নফল রোজা। এ ছাড়া কোনো সময় ও দিন–তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যত বেশি সম্ভব নফল ইবাদত করা যায় এবং তা করা উচিত।
সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনো ফরজ ওয়াজিব ছুটে না যায় এবং কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় রজব মাসে ১০টি নফল রোজা রাখতেন এবং শাবান মাসে ২০টি নফল রোজা রাখতেন। রমজানে পূর্ণ মাস ফরজ রোজা। নবীজি (সা.) রমজান ছাড়া বছরের সবচেয়ে বেশি শাবান মাসেই নফল নামাজ, নফল রোজা ও নফল ইবাদত–বন্দেগি করতেন।
রমজান মাসের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা বিশেষ জরুরি একটি সুন্নত আমল। হাদিস শরিফে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ, আলবানি, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১০৩)
চাঁদের ২৯ ও ৩০ তারিখ নতুন চাঁদ দেখার চেষ্টা করা সুন্নত, চাঁদ দেখে দোয়া পড়াও সুন্নত; চান্দ্রমাসের তারিখের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। কারণ, ইসলামি বিধিবিধান চাঁদের তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল ফিকহুল ইসলামি)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com