মুসলিম উম্মাহ আজ শুক্রবার পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়। ছবি: রয়টার্স
মুসলিম উম্মাহ আজ শুক্রবার পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়। ছবি: রয়টার্স

হজ সফর ১৪

আরাফাতে অবস্থানই হজ

আরাফার তাঁবুগুলো মিনার তাঁবুর চেয়ে অনেক বড়। একটার ভেতরেই ৪৫০-৫০০ জন হাজি থাকতে পারেন। আর মিনার তাঁবুর মতো এখানেও বিছানা ভাঁজ করে বসার সোফা বানানো যায়। প্রতিজনের জন্য একটা স্লিপিং ব্যাগ দেয়া হয়েছে, মুজদালিফায় নিয়ে যেতে। আমরা অনেকেই টয়লেট সেরে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতটা গরম ছিল না। মরুভূমির বৈশিষ্ট্য অনুসারে বরং হালকা ঠান্ডাই অনুভূত হচ্ছিল।

ফজরের সময় উঠে অজু করে সালাত আদায় করে নিলাম। কেউ কেউ বাইরে গিয়ে প্রধান ফটকের নিচ দিয়ে শরীর গলিয়ে বড় রাস্তায় উঠে মসজিদের নামিরায় গেলেন। আসলে অনেকগুলো তাবু নিয়ে বিশাল প্রাঙ্গণটির চারদিকের ফটক সব বন্ধ করা ও প্রহরাধীন যেন এখানকার নির্ধারিত হাজি ছাড়া কেউ এখানে ঢুকতে না পারেন, আবার এখান থেকে যেন কেউ বেড় হতে না পারেন। আমাদের তাবুগুচ্ছের বা প্রাঙ্গণের নম্বর ছিল ১৬/৪৪। এর উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে চলে গেছে রয়েল প্যালেস রোড ও বাদশা ফয়সাল রোড।

ফজরের সালাতের পর আবার শুয়ে পড়া। হজের প্রধানতম কাজ ওকুফে আরাফা বা আরাফায় অবস্থানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে দুপুরে জোহরের ওয়াক্তে। আসলে ভোর থেকেই আমাদের ওকুফে আরাফা শুরু হয়ে গেছে। কারণ, আমরা আরাফার ময়দানের একাংশে অবস্থান করছিলাম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আলহাজ্জু আরাফা।’ (হজ হচ্ছে আরাফা।) এটি ঠিকমতো করতে না পারলে হজ বাতিল হবে এবং এর কোনো দম বা ক্ষতিপূরণ নেই।

সূর্য আস্তে আস্তে পুব দিকে থেকে উঠতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে গরমও বাড়তে শুরু হলো। বিশাল তাঁবুর ভেতরে কয়েকটি এসি থাকলেও মরুর উত্তাপের কাছে ধীরে ধীরে হার মানতে শুরু করল সেগুলো। এর মধ্যে নাশতা এল। তানজীর, আজম, সামী এরা আমাদের নাশতা বিতরণ করল। নাশতা সেরে তাবুর বাইরে এলাম। ওখানে চায়ের ব্যবস্থা ছিল।

আমাদের বলা হয়েছিল যে তাঁবুর ভেতরে অবস্থান করেই দোয়া করতে ও নামাজ পড়তে। কিন্তু বাইরের চেয়ে ভেতরে গরম বেশি, গুমোট ভাবও প্রবল হয়ে উঠছিল। আর বাইরের খোলা প্রাঙ্গণে আবার জায়গায় জায়গায় গাছ আছে। মৃদু বাতাসও বইছে। অনেকে দেখে-বেছে এরকম জায়গায় অবস্থান নিতে শুরু করলেন। আমরাও তাই করব ঠিক করলাম। তানজীর দ্রুত স্লিপিং ব্যাগ ও চাদর নিয়ে বাইরে এলো। আমি ও শাহাদাত ভাই মিলে তাঁবু থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে একটা জায়গা বেছে নিলাম যেখানে কিছুটা গাছের ছায়া আছে। এগুলো মরুর উপযোগী নিম গাছ। ওখানেই চাদর বিছিয়ে বসলাম আমরা।

অনেকেই কাছে থাকা কলতলায় গোসল সারছিলেন। আমি ভালো করে গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে ফেললাম। পরনের ইহরামের কাপড় পাল্টে নতুন আরেক সেট লেবাস পড়লাম। তারপর অজু করলাম। এদিক পানির তেষ্টা বেড়েই চলেছে। গলায় পানি ঢালছি একটু পর পর। বোতলের পর বোতল খালি হতে লাগল। তবে পানি যেন মরুর বুকে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছিল। মানে শরীর খুব শুষ্ক হয়ে পড়েছিল।

দুই

আমাদের তাঁবু প্রাঙ্গণ থেকে নামিরা মসজিদ বেশি দূরে নয়। সূর্যও মাথার ওপরে চলে এসেছে। মাইকে হালকা ভেসে আসছিল নামিরার খুতবা। খুতবার পরই আজান হলো। নামিরায় আজানের পর দুই ইকমাতে প্রথমে জোহরের সালাত, তারপরে আসরের সালাত হয়। আর তা হয় দু রাকাত করে কসর হিসেবে।

তবে আমাদের অনেকেই শুধু জোহরের ফরজ সালাত চার রাকাত আদায় করলেন। এ নিয়ে আগেও আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। উপস্থিত অনেক মাওলানা ও আলেম বলেছিলেন যে নামিরায় না গেলে এবং তাঁবুর ভেতর থাকলে জোহরের ওয়াক্তে জোহর ও আসরের ওয়াক্তে আসরের ফরজ চার রাকাত করে আদায় করতে হবে। কসর করা যাবে না।

কিন্তু আমরা কয়েকজন তাঁদের সঙ্গে একমত হইনি। রাসুল (সা.) জোহর ও আসর দু রাকাত কসর করে পরপর আদায় করেছিলেন এবং তাঁর সাথে উপস্থিত সকল হাজী তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন। তা ছাড়া এই কসর হলো হজের দিনে আরাফার কসর যার সঙ্গে সফরের কসরের কোনো সম্পর্ক নেই। আরাফার সীমানার ভেতরে যে কোনো জায়গা হাজিরা অবস্থান নেন না কেন, তাঁদের ওকুফে আরাফা হয়ে যায়। কোনো বিশেষ জায়গা নেই। আর পুরো আরাফার জন্য একই হুকুম।

আমি ও তানজীর কসর করে পরপর জোহর ও আসরের সালাত আদায় করে নিলাম। আমার সহধর্মিণীও তাঁবুর ভেতর একইভাবে সালাত আদায় করলেন।

এদিকে তাঁবুতে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। দুম্বার বিরিয়ানি ও কোমল পানীয়। এই খাবার আনতে গিয়ে আক্তার ভাইকে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রচণ্ড গরমে আমরা কেউ কেউ এই খাবার খাওয়ার সাহস করলাম না। তার বদলে শাহাদাত ভাই আমাদের খেজুর, বাদাম ও কিশমিশ খেতে দিলেন।

আরাফার দিন কোনো সুন্নত বা নফল নামাজ পড়ার বিধান নেই। বরং একত্রে জোহর ও আসর আদায় করে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত দোয়া করতে থাকাই সবচেয়ে বড় কাজ। খাওয়া সেরে আমরা দোয়া-দরুদে মনোযোগী হলাম। বেলা যত গড়াতে লাগল, হাজিরা তত তাঁবু থেকে বাইরে খোলা প্রাঙ্গণে এসে দোয়া করতে লাগলেন। একটা সময় পুরো প্রাঙ্গণ হাজিদের কান্না সহযোগে দোয়াদরুদ ভরে উঠল।

আমি ও আমরা সহধর্মিণী পাশাপাশি কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বা বসে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে জীবনের সব গুনাহর জন্য মাফ চাইলাম, বাকি জীবন গুনাহমুক্ত থাকার তৌফিক চাইলাম, চাইলাম আমৃত্যু শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, চাইলাম হালাল রিজিক ও নেক আমলের ওপর থাকার সক্ষমতা। আমাদের দু জনের মরহুম বাবার জন্য বারবার মাফ চাইলাম, তাঁদের জন্য কেয়ামতে বিনা বিচারে জান্নাতে চাইলাম। আমাদের মায়েদের জন্য দোয়া করলাম আর কাদঁলাম। এটা এমন এক সময় যখন মনের আবেগের বাঁধ ভেঙে যায়, নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার ওপর ছেড়ে দেয়া যায়, যায় প্রাণখুলে অন্তর থেকে আপন ভাষায় আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাওয়া।

সূর্য যখন শেষ রশ্মি ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর চারদিক থেকে মৃদু হাওয়া নিরবধি বয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছিল সত্যি আল্লাহ আমাদের জিন্দেগির শ্রেষ্ঠতম সুযোগটা দিলেন এবং তাও অনেক সহজ করে।

সূর্যাস্তের পরই আরাফা থেকে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দিতে শুরু করলেন হাজিরা। কেউ একজন বলছিলেন যে এখানে দেরি করলে দম দিতে হবে। আমরা কয়েকজন জোরালোভাবে বললাম যে এ রকম কোনো বিধান নেই। বরং ধীরে সুস্থে রওনা হতে পারলেই ভালো। ছোট ছোট দল করে আমরা এগোতে লাগলাম। আর একটু পর পর থামতে হলো সৌদি পুলিশের বাধা পেয়ে। ওরা আসলে প্রতিটি দলের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখছিল। এভাবে আমাদের তাবুগুচ্ছ প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে ট্রেনে উঠতে প্রায় দু ঘণ্টা লেগে গেল।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক