দুঃখ পেলেন আবু তালিব। তিনি ভীষণ ভাবিত হলেন। তাঁর আপন লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাবে, নিজের লোক দুশমন হবে। অথচ রাসুলকে (সা.) ত্যাগ করা, তাঁকে ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
ইয়াকুব ইবনে উতবা ইবনে আল-মুগিরা ইবনে আল-আখনাস আমার কাছে বলেছেন যে তাঁর কাছে বলা হয়েছে যে, কোরাইশদের এ ধরনের কথা শোনার পর আবু তালিব ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘এবার আমাকে নিষ্কৃতি দাও, নিজেকেও বাঁচাও। যে বোঝা আমি বহন করতে পারব না, সে বোঝা আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ো না।’
রাসুলে করিম (সা.) ভাবলেন, তাঁর চাচা বুঝি তাঁর প্রতি বিরূপ হয়েছেন, সুতরাং তিনি তাঁকে ত্যাগ করবেন। বুঝি তিনি তাঁর সাহায্য ও সমর্থন থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘হে চাচা, আমার আল্লাহ্র নামে কসম খেয়ে বলছি, ওরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাঁ হাতে চন্দ্রও এনে দেয়, আর বলে “এইসব তুমি ত্যাগ করো” আমি ছাড়ব না। আল্লাহ্ আমাকে হয় বিজয়ী করবেন, না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তার আগে আমি থামব না।’
এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাসুল (সা.)। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাবেন বলে কয়েক কদম এগোলেন। অমনি আবু তালিব বলে উঠলেন, ‘এসো, ফিরে এসো ভ্রাতুষ্পুত্র।’
রাসুল (সা.) ফিরে এলেন।
আবু তালিব বললেন, ‘তোমার যেখানে খুশি যাও, যা খুশি বলো। আল্লাহ্র নামে শপথ, আমি কোনো দিন কোনো কিছুর জন্য তোমাকে ত্যাগ করব না।’
কোরাইশরা বুঝতে পারল, আবু তালিব রাসুলে করিমকে (সা.) ত্যাগ করবেন না। বরং তাদের সঙ্গেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। উমারা ইবনে আল-ওয়ালিদ ইবনে আল-মুগিরাকে সঙ্গে নিয়ে তারা তাঁর কাছে গেল। আমি যত দূর শুনেছি, সেখানে গিয়ে তারা বলল, ‘আবু তালিব, এর নাম উমারা। কোরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বলিষ্ঠ জোয়ান। ওকে আপনি গ্রহণ করুন, ওর বুদ্ধি আর সাহায্যের সুবিধা নিন। ছেলে হিসেবে গ্রহণ করুন তাকে আর আপনার ওই ভাতিজাকে ছেড়ে দিন আমাদের হাতে। সে আমাদের ধর্ম, আমাদের বাপ-দাদাদের ধর্মের নামে অপবাদ দিচ্ছে, সে আমাদের মধ্যে বিভেদ ডেকে আনছে, আমাদের চালচলনকে উপহাস করছে। ওকে আমরা হত্যা করব। তার বদলে এই একে নিন, মানুষের বদলে মানুষ।’
তিনি বললেন, ‘এ এক অসম্ভব বাজে কথা বলছ তোমরা, এক অশুভ জিনিস আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছ। আমি যদি বলি, তোমার ছেলেকে আমাকে দাও আমি তাকে খাওয়াব পরাব, বদলে আমার ছেলেকে নাও, হত্যা করো নিয়ে তাকে, সেটা কি যুক্তিসংগত হবে? আল্লাহ্র কসম, এ কোনো দিন হওয়ার নয়।’
আল-মুতিম বিন আদি বলল, ‘আপনার লোকজন আপনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে, আপনি যা না-পছন্দ করেন তা করেনি। আমার মনে হয় তাদের সঙ্গে আপনি আর থাকতে চান না।’
আবু তালিব জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ্র কসম, তারা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য, আমার বিরুদ্ধে লাগার জন্য সবাই তোমরা জোট বেঁধেছ। কাজেই তোমাদের যা খুশি করতে পারো।’
অথবা এমন কিছু তিনি বললেন।
পরিস্থিতি সঙ্গিন হয়ে গেল। বিবাদ উত্তেজনা বৃদ্ধি করে চলল। সব লোক দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল, প্রকাশ্যে তারা তাদের শত্রুতা ঘোষণা করে যেতে লাগল।
আবু তালিব একটি কবিতা লিখলেন তখন। এতে মুতিব এবং আবদু মানাফ গোত্রের অন্যান্য যারা তাঁকে ত্যাগ করেছিল, তাদের এবং কোরাইশদের মধ্যে তার অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণ করা হয়েছে। তাঁর কাছে তারা কী চেয়েছিল, কী জন্য সবাইকে তিনি বিমুখ করলেন, এসব কথা কবিতায় বলা আছে।
তারপর কোরাইশরা রাসুলে করিমের (সা.) সঙ্গীদের, যাঁরা মুসলমান হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লোকজনকে লেলিয়ে দিতে শুরু করল। যাঁরা মুসলমান হয়েছেন তাঁদের ওপর সমস্ত গোত্র ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাঁদের মারধর করে তাঁদের ধর্ম ত্যাগ করার জন্য প্ররোচিত করতে লাগল। আল্লাহ্ চাচার মাধ্যমে রাসুলে করিমকে (সা.) রক্ষা করলেন। চাচা আবু তালিব যখন দেখলেন, কোরাইশদের মতলব খারাপ, তখন তিনি বনু হাশিম আর বনু আল-মুত্তালিবকে ডাকলেন। রাসুলে করিমকে (সা.) বাঁচানোর জন্য তিনি তাঁদের সাহায্য চাইলেন। তাঁরা সাহায্যদানে সম্মত হলেন। কেবল একজন ছাড়া। সে হলো আবু লাহাব, আল্লাহ্র অভিশপ্ত শত্রু।
তাঁর গোত্রের কাছ থেকে এমন সাড়া পেয়ে, তাঁদের এমন অনুগ্রহের জন্য ভীষণ পুলকিত হলেন আবু তালিব। তিনি তাঁদের প্রশস্তি গাইতে লাগলেন, তাঁদের অতীত কীর্তিকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে লাগলেন। বললেন, তাঁদের সবার মধ্যে রাসুলে করিম (সা.) শ্রেষ্ঠ, তাঁর মর্যাদা স্বতন্ত্র। তিনি ভাবলেন, তাতে করে তাঁদের মনোবল দৃঢ়তর হবে এবং রাসুলের প্রতি তাঁরা সদয় হবেন।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে