মহানবী (সা.)-র জীবনের শেষ ১৫ দিন

একাদশ দিন: ৮ রবিউল আউয়াল, ৪ জুন, বৃহস্পতিবার

এই দিন একদল আনসারের পাশ দিয়ে আবু বকর ও আব্বাস (রা.) যাচ্ছিলেন। দেখলেন, তাঁরা সকলে কাঁদছে। দুজনেই তাদের কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। তারা বললেন, নবীজির (সা.) সাহচর্য ও তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোর কথা মনে পড়ছে।

জানতে পেরে নবীজি (সা.) বাইরে বেরিয়ে এলেন। নিজের মাথা তিনি চাদরের প্রান্তদেশ গিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তিনি মিম্বরে বসলেন। আল্লাহর প্রশংসা করলেন। এরপর বললেন, ‘আনসারদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের উপদেশ দিচ্ছি তোমাদের। তারা আমার আস্থাভাজন এবং আমার গোপন রহস্যের ধারক। তাদের দায়িত্ব তারা পালন করেছে। তাদের যে অধিকার অন্যদের ওপর, সেটা রয়ে গেছে। তাদের ভালো লোকদের গ্রহণ করবে এবং অন্যায় করলে ক্ষমা করবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩,৭৯৯)

আবুল হাসান আলি নদভি বলেন, নির্ভরযোগ্য মত হলো, এটাই ছিল মিম্বরে বসে দেওয়া নবীজির (সা.) শেষ বক্তব্য। বৃহস্পতিবার জোহর নামাজের পর তিনি এই বক্তব্য দেন। (আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ৫৩৫)

দ্বাদশ দিন: ৯ রবিউল আউয়াল, ৫ জুন, শুক্রবার

নবীজির (সা.) অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। আয়িশা (রা.) কে বলেন, খয়বার যুদ্ধের পর এক ইহুদি নারী নবীজিকে (সা.) বিষ দিয়েছিলেন। সে কথা স্মরণ করে নবীজি (সা.) বলতে থাকেন, ‘আয়িশা, আমি খয়বারে যা খেয়েছিলাম সে-খাবারের জ্বালা এখন অনুভব করছি। সেই বিষক্রিয়া আমার ধমনি কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।’ (বুখারি, হাদিস: ৪,৪২৮)

কয়েকজন সাহাবি আয়িশার (রা.) ঘরে আসেন নবীজি (সা.)-কে দেখতে। তিনি পরম উৎসাহে তাঁদের স্বাগত জানান। তাঁদের জন্য হেদায়েতের প্রার্থনা করেন। বলেন, ‘উপদেশ দিচ্ছি, আল্লাহকে ভয় করো। আমার পরে আল্লাহর কাছে তোমাদের অভিভাবকত্ব সোপর্দ করছি। আমি ছিলাম তোমাদের জন্য তাঁর প্রকাশ্য ভীতি প্রদর্শনকারী। দেখো, আল্লাহর বান্দা ও তার ভূমিতে অহংকারে মেতে উঠবে না। কেননা, আল্লাহ আমাকে ও তোমাদের বলেছেন, ‘এই পরকাল আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা পৃথিবীর বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না। খোদাভীরুদের জন্য শুভ পরিণাম (সুরা কাসাস, আয়াত ৮৩)।’

এরপর তিনি পাঠ করেন, ‘অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নামে নয় কি?’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৬০; সিরাতে ইবনে কাসির, ৪/৫০২)

এরপর তিনি বললেন, ‘সময় শেষ হয়ে এসেছে এবং প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকে।’

উপস্থিত সাহাবিরা জানতে চান, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনাকে গোসল দেবে?’ তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের পুরুষেরা, যারা সবচেয়ে কাছের মানুষ।’ তাঁরা জানতে চান, ‘কোন কাপড়ে কাফন দেব?’ তিনি বলেন, ‘আমার এই (পরনের) কাপড়ে, যদি তোমরা চাও, ইয়েমেনি হুল্লা অথবা মিসরের সাদা কাপড়ে।’ জানতে চান ‘কে জানাজা পড়াবে?’ তিনি বলেন, ‘প্রথমে জানাজা পড়বে আমার পরিবারের পুরুষেরা, পরে তোমরা।’ জানতে চান, ‘কে কবরের সমাহিত করবে?’ তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের পুরুষেরা, সঙ্গে অনেক ফেরেশতা—যারা তোমাদের দেখবে, তোমরা তাদের দেখবে না। (হাইসামি, মাজমা আয-যাওয়ায়িদ ওয়া মানবা আল-ফাওয়ায়িদ, ৯/২৫)

ত্রয়োদশ দিন: ১০ রবিউল আউয়াল, ৬ জুন, শনিবার

অসুস্থতা বেড়ে চলে। এদিন ইশার সময় বিলাল (রা.) আজান দেন। খানিক পরে নবীজি (সা.) জানতে চান, লোকেরা নামাজ পড়েছে কি? সাহাবিরা উত্তর দেন, ‘না, আল্লাহর রাসুল, সবাই আপনার অপেক্ষা করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জন্য পাত্রে পানি রাখো।’ পানি দেওয়া হলে তিনি গোসল করেন। এরপর উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং জ্ঞান হারান। চেতন হলে আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘নামাজ কি পড়েছে সবাই?’ সবাই জানান, ‘না, আল্লাহর রাসুল, আপনার অপেক্ষা।’ মসজিদে নববিতে চুপচাপ এশার নামাজের অপেক্ষায় ছিলেন সাহাবিরা। অবশেষে তিনি আয়িশা (রা.) ও তাঁর কাছের লোকদের বললেন, ‘আবু বকরকে বলো নামাজ পড়াতে।’ আয়িশা (রা.) বললেন, ‘আবু বকর (রা.) নরম মানুষ, তার কণ্ঠস্বর দুর্বল। তিনি কোরআন পড়তে পড়তে কাঁদবেন, ফলে লোকেরা তার আওয়াজ শুনবে না। আমরা ওমরকে (রা.) বলি?’ (বুখারি, হাদিস: ৬৮২)

আবদুল্লাহ ইবনে জামআ নবীজি (সা.)–কে দেখতে আসেন। সঙ্গে আরও লোক ছিল। তিনি বাইরে এসে আবু বকরকে (রা.) পেলেন না, পেলেন ওমরকে। বললেন, ‘ওমর, তুমি নামাজ পড়াও।’ ওমর নামাজ শুরু করেন। নবীজি (সা.) ওমরের স্বর শুনে বললেন, ‘আবু বকর কোথায়? আল্লাহ এবং মুসলিমরা তাকে (ওমরকে) চান না।’ (সুনান আবু দাউদ, ৪,৬৬০)

তারপর নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা ইউসুফের সঙ্গিনীরা, তাকে (আবু বকরকে) বলো যেন তিনি নামাজ পড়ান।’ তারা আবু বকরকে ডাকেন। ওমর নামাজে ক্ষান্তি দেন। পরে আবদুল্লাহ ইবনে জামআকে বলেন, ‘তুমি এটা কী করলে? আমি ভাবলাম নবীজি (সা.) বুঝি আমাকে বলতে বলেছেন। তিনি বলেননি জানলে আমি কখনো নামাজ পড়াতাম না।’ ইবনে জামআ বলেন, ‘না, নবীজি (সা.) আমাকে বলেননি, আবু বকরকে না-দেখে ভাবলাম তোমারই অধিকার বেশি।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, অধ্যায় ৯, হাদিস ৪১৭)

আবু বকর (রা.) এসে বললেন, ‘ওমর, তুমি পড়াও।’ ওমর বললেন, ‘বরং আপনিই বেশি যোগ্য।’ ফলে নবীজির (সা.) অসুস্থতার বাকি কয়টা দিন আবু বকরই (রা.) নামাজ পড়াতে থাকেন। (বুখারি, হাদিস: ৬৮২)

উম্মে ফজল বিনতে হারিস বলেন, ‘সর্বশেষ মাগরিবের নামাজে নবীজি (সা.) আমি সুরা মুরসালাত পড়তে শুনেছি। পরে আর কোনও নামাজ পড়ানোর সুযোগ হয়নি তার।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৪২৯)

সফিউর রহমান মোবারকপুরি তার বিখ্যাত ‘আর-রাহিক আল-মাখতুম’ গ্রন্থে লিখেছেন, অসুস্থ অবস্থায় নবীজি (সা.) মোট এগারো দিন নামাজ পড়ান।

চতুর্দশ দিন: ১১ রবিউল আউয়াল, ৭ জুন, রবিবার

নবীজির (সা.) অসুস্থতা অব্যাহত থাকে। জ্বর-মাথাব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। রোজকার মতো জ্ঞান হারান, আবার ফিরে পান। শরীরের তাপ কমাতে পরিবারের সদস্যদের পানি ঢালতে বলেন। ওসামার বাহিনীকে দ্রুত পাঠাতে বলেন।

আয়িশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, আয়িশা, সেই সোনার মুদ্রাগুলো কী করেছ? আমি পাঁচ বা সাত কিংবা ৯টির স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এলাম। তিনি সেগুলো হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলেন এবং বললেন, আমি এগুলোসহ আল্লাহকে কীভাবে মুখ দেখাব? যাও, সব আল্লাহর জন্য বিতরণ করে দাও।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, ৮/৮, হাদিস ৩২১২)

দুপুরের দিকে তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। শরীরও অনেকটা হালকা মনে হয়। তিনি আব্বাস ও আলীর কাঁধে ভর দিয়ে জোহর নামাজে মসজিদে আসেন। নামাজ চলছিল। আবু বকর তাঁকে দেখে পেছনে আসতে চাইলে নবীজি ইঙ্গিতে তাঁকে বারণ করেন। আব্বাস ও আলিকে বলেন, তাঁকে যেন আবু বকরের পাশে বসিয়ে দেয়। আবু বকর নামাজ অব্যাহত রাখেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তার পাশে বসে নামাজ আদায় করেন। (বুখারি, হাদিস: ৬৮৭)

পঞ্চদশ দিন: ১২ রবিউল আউয়াল, ৮ জুন, সোমবার

গত রাতে নবীজি (সা.)-এর শারীরিক অবস্থার খানিক উন্নতি হয়। তিনি ফজরে ওঠেন। নামাজে সাহাবিরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়িশা (রা.) দুয়ারের পর্দা তুলে দেন। নবীজি (সা.) কিছুক্ষণ দেখেন। দেখেন, মুসলিমরা প্রভুর ডাকে হাজিরা দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, তাঁর চেহারা খোলা পৃষ্ঠার মতো। সাহাবিরা বলেছেন, ‘ধারণা হয়েছিল, খুশিতে আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব। ইঙ্গিতে তিনি তাদের নামাজে মনোযোগ দিতে নির্দেশ দেন এবং তাঁদের অবস্থা দেখে মৃদু হাসেন। (বুখারি, হাদিস: ৬৮০)

তিনি আবু বকরের পাশে বসে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে বলেন, ‘লোকসকল, আগুনের জ্বলন্ত শিখা এবং রাতের অন্ধকারের মতো ফিতনা ধেয়ে আসছে। আমি কেবল তা-ই বৈধ করেছি, যার বৈধতা কোরআন দিয়েছে এবং তা-ই অবৈধ বলেছি যা কোরআন নিষিদ্ধ করেছে। শোনো, তোমাদের ওপর অবশিষ্ট আমার আর কিছু নেই। যা করেছি তোমাদের সঙ্গে, তা কোরআনের আলোকে করেছি।’

নবীজি (সা.) আবার ঘরের শয্যায় ফিরে আসেন। আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর নবী, আপনাকে সুস্থ দেখে মনে হচ্ছে, আজ আমার স্ত্রী খারিজার সঙ্গে সময় কাটাতে পারি। নবীজি (সা.) সম্মতি দিলে তিনি বাড়ি চলে যান।

অনেকে আলী (রা.)–কে জিজ্ঞেস করেন, নবীজি (সা.) কেমন আছেন? আলী (রা.) বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, তিনি এখন ভালো।’ আব্বাস বলেন, ‘আলী, নবীজির (সা.) মুখে আমি মৃত্যুর ছায়া দেখেছি, আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরা মুমূর্ষু অবস্থায় কেমন হয় আমার জানা। চলো তাঁকে দেখতে যাই।’ আলি (রা.) বলেন, ‘আমি তা করব না, কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ আমাদের নবী (সা.)–কে রক্ষা করবেন।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৬৫৩-৬৫৪)

জোহরের ওয়াক্তে আবু বকরের (রা.) ছেলে আবদুর রাহমান নবীজির (সা.) ঘরে আসেন। তখন তাঁর হাতে পিলু গাছের একটি তাজা ডাল ছিল। তিনি ডালটি এক নজর দেখলেন। আয়িশা (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর নবী, আপনি এটি চান?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ।’ আয়িশা সেটি নরম করে মিসওয়াক বানিয়ে দিলেন। তিনি ভালোভাবে দাঁত পরিষ্কার করলেন। শেষে মিসওয়াকটি আয়িশাকে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু হাত থেকে পড়ে গেল।

নবীজি (সা.) আয়িশার ঊরুতে শুয়ে ছিলেন। পানির একটি পাত্র ছিল, তিনি হাত ডোবাচ্ছিলেন আর ভেজা হাত দিয়ে বারবার চেহারা মুছছিলেন। বলছিলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর নেই, মৃত্যুর যন্ত্রণা অবধারিত।’ একটু সময়ের জন্য জ্ঞান হারালেন। তারপর চোখ মেলে ছাদের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘ফির রফিক আল-আ’লা, ফির রফিক আল-আ’লা—সর্বোত্তম বন্ধুর কাছে, সর্বোত্তম বন্ধুর কাছে।’ আর তাঁর প্রাণ বেহেশতে সেই বন্ধুর কাছে চলে যায়। (বুখারি, হাদিস: ৪,৪৪৯ ও মুসলিম, হাদিস: ২,১৯২)

সূত্র: দিন-তারিখ নির্ণয় ও রেফারেন্স গ্রহণে জর্ডানের ইলেকট্রনিক সিরাতুন্নবি গেটওয়ে প্রকল্প ‘আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাত আর-রাসুল’, ‘আল-মাকতাবা আশ-শামিলা’, ‘ইসলাম ওয়েব’ ও ‘সুন্নাহ ডট কম’।