রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেক সাহাবিকে বিয়ের পরামর্শ দেন। কে কাকে বিয়ে করলে ভালো হবে, সেটা তিনি উল্লেখ করতেন। কেউ কেউ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সঙ্গে পরামর্শ করতেন, ‘আমাকে অমুক অমুক বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, কাকে বিয়ে করব?’
সাহাবিদের সময়ে বিয়ে, তালাক, মাসনা-সুলাসা, বিধবা বিয়ে, তালাকপ্রাপ্তদের বিয়ে—এগুলো ছিল স্বাভাবিক। যেকোনো বিয়েতে ‘তালাক’ প্রত্যাশিত নয়। বিয়ের সময় কেউ চায় না সেই বিয়ে তালাকের মাধ্যমে শেষ হোক। কিন্তু বিয়ের সম্পর্ক যদি ঠিকমতো না চলে, দাম্পত্য জীবনে যদি পারস্পরিক বনিবনা না হয়, তাহলে তালাকের প্রয়োজন দেখা দেয়।
সাহাবিদের সময় কোনো নারী তালাকপ্রাপ্ত হলে তাঁকে খারাপ চোখে দেখা হতো না। খুব সহজে আবার তাঁর জন্য বিয়ের প্রস্তাব যেত। বিয়ে হতো। তালাকপ্রাপ্ত নারীকে নেতিবাচক চোখে দেখা হতো না।
আবু বকর, উমর ইবনে খাত্তাব, যুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.)–সহ অনেক বড় বড় সাহাবির কারও সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে তালাকের মাধ্যমে। আবু বকর এবং উমর (রা.)–এর পুত্রদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর একজন সাহাবি। তিনি ছিলেন মক্কার অধিবাসী। ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
ফাতিমার প্রথম স্বামী ছিলেন আবু আমর হাফস ইবনে মুগিরা (রা.)। আবু আমর তাঁকে আগেই দুই তালাক দেন। একটি অভিযানে বের হওয়ার পর আবু আমর তাঁদের বিয়ের উকিল আইয়াশ ইবনে আবি রাবিয়া (রা.)–এর মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে তিনি ফাতিমাকে তৃতীয় তালাক দিয়েছেন।
আবু আমর তাঁর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর খোরপোশের জন্য পাঁচ সা যব ও পাঁচ সা খুরমা পাঠান। ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, এখন তিনি থাকবেন কোথায়? আগে তো স্বামীর ঘরে ছিলেন। ইদ্দত পালন করবেন কোথায়?
বিয়ের উকিল জানান, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। তাঁর স্বামী শুধু এগুলো দিয়ে পাঠিয়েছেন।
ফাতিমা (রা.) রাগান্বিত হলেন। বললেন, ‘আল্লাহর কসম! যদি খোরাক ও বাসস্থান আমার প্রাপ্য হয়ে থাকে, তবে আমি তা চাইব। আমি এই নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করব না।’ (সুনানে আন-নাসায়ি, ৩,২৪৪)
ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে গেলেন। তাঁর কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন শুনলেন আবু আমর (রা.) তাঁকে তিন তালাক দিয়েছেন, তখন তিনি বললেন, ‘এখন তোমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আবু আমরের নয়। তুমি অমুক মহিলার কাছে গিয়ে ইদ্দত পালন করো।’
মদিনায় তখন তাঁর ‘বাপের বাড়ি’ ছিল না যে তিনি চাইলে সেখানে গিয়ে ইদ্দত পালন করবেন। আরেকজন সাহাবি তাঁকে বিয়ে করার আগ পর্যন্ত তিনি কোথায় ইদ্দত পালন করবেন?
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পরামর্শ দেন উম্মু শুরাইক (রা.)–এর বাড়িতে যেতে। তিনি বললেন, ‘তুমি উম্মু শুরাইকের কাছে যাও। উম্মু শুরাইক সম্পদশালী আনসারি নারী, আল্লাহর রাস্তায় অনেক দান করেন। তাঁর কাছে অনেক অতিথি সমাগম হয়।’ (সুনানে আন-নাসায়ি, ৩,২৩৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) যে কারণে ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.)–কে উম্মু শুরাইক (রা.)–র বাড়ি যেতে বলেন, একই কারণে আবার তাঁকে যেতে নিষেধ করেন। কারণ উম্মু শুরাইকের বাড়িতে অনেক মেহমানের আনাগোনা হয়। ফাতিমা বিনতে কায়সের ইদ্দত পালনে সমস্যা হতে পারে। তাঁর পর্দার লঙ্ঘন হতে পারে। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাতিমাকে তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে উম্মু মাকতুম (রা.)–এর বাড়িতে ইদ্দত পালনে বলেন। (সহি মুসলিম, হাদিস: ৭,২৭৬)
ফাতিমা বিনতে কায়স ছিলেন অসম্ভব রূপবতী একজন নারী। একই সঙ্গে ছিলেন মেধাবী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, আল-ইসাবা, ৪/৩৮৪)
ইদ্দত পালন শেষে অনেক সাহাবি ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.)–এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তিনি সেসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে যান। রাসুল (সা.) জানতে চান, কারা কারা প্রস্তাব পাঠিয়েছে? ফাতিমা (রা.) বললেন, মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান ও আবু জাহম (রা.)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দুই প্রস্তাবকারীর ‘জীবনবৃত্তান্ত’ বিশ্লেষণ করে জানালেন, মুয়াবিয়া তো এখনো যুবক। তাঁর (আপাতত) কোনো সম্পদ নেই। আর (আবু জাহম) রুক্ষ মেজাজের। তাঁর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। (সুনানে আন-নাসায়ি, ৩,২৪৪)
বিয়ের সময় পাত্রপাত্রীর দোষত্রুটি তুলে ধরাকে ইসলাম গিবত বলে বিবেচনা করে না। বিয়ের ক্ষেত্রে বরং এগুলো পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। এতে ভবিষ্যতে ঝামেলা হয় না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.)–এর কাছে আসা দুটো প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিলেন তাঁদের বিয়ে না করতে। তিনি প্রস্তাব দিলেন উসামা ইবনে যায়িদ (রা.)–র ব্যাপারে।
ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.) জানতেন, রাসুল (সা.) উসামা ইবনে যায়িদ (রা.)–কে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যে আমাকে ভালোবাসে, সে যেন উসামাকেও ভালোবাসে।’ (সহি মুসলিম, হাদিস: ৭,২৭৬]
ফাতিমা (রা.) বিয়ের পুরো এখতিয়ার ছেড়ে দেন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ওপর। তিনি বলেন, ‘আমার (বিয়ের) বিষয়টি আপনার ইচ্ছেমাফিক ছেড়ে দিলাম। আপনি যার সঙ্গে ইচ্ছে আমাকে বিয়ে দিন।’ (সহি মুসলিম, হাদিস: ৭২৭৬)
বিয়ের পুরো দায়িত্ব রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ওপর দেওয়া সত্ত্বেও প্রথমে তিনি উসামা উবনে যায়িদ (রা.)–কে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। তবে পরবর্তীকালে মেনে নেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর পরামর্শ অনুসারে বিয়ে করায় কী লাভ হয়েছিল, সেই বর্ণনা তিনি নিজে দিয়েছেন এভাবে, ‘আল্লাহ আমাদের এই দাম্পত্য জীবনের মধ্যে এত বরকত দান করেন, তাতে আমি বাকিদের ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হলাম!’ (সুনানে আবু দাউদ, ২,২৮৪)