ইসলামে যত ধরনের নফল আমল-ইবাদত রয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ আমল হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার সময় হলো শেষ রাত; রাতের চতুর্থ প্রহর। রাতের চারটি প্রহর সম্পর্কে কবি লিখেছেন, ‘প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী। তৃতীয় প্রহরে তস্কর (চোর) জাগে, চতুর্থ প্রহরে যোগী (সাধক)।’
আবু হুরায়রা (রা.)–র বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ–তাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন, কে আছে এমন—যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন—যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন—আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনায় আছে যে তিনি বলেন, হে আবদুল্লাহ! কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদের নামাজ) কখনো ছেড়ো না। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) তা কখনো ছাড়েননি। কখনো অসুস্থতা বা দুর্বলতা বোধ করলে বসে আদায় করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩০৯)
প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিমের পক্ষে শেষ রাতে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা সম্ভব হয় না। তাদের জন্য চমৎকার একটি সমাধান রয়েছে, এমন সাতটি আমল রয়েছে, যেগুলো আদায় করলে বা বাস্তবায়ন করলে শেষ রাতে জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় না করেও তাহাজ্জুদ আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব অর্জন করা সম্ভব। কী সেই আমলগুলো? আসুন সেসব আমলগুলো জেনে নিই:
১. এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করল, সে যেন পূর্ণ রাত নফল (তাহাজ্জুদের) নামাজ আদায় করল।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৫৫৫; মুসলিম, হাদিস: ৬৫৬; তিরমিজি, হাদিস: ২২১)
২. রাতে পবিত্র কোরআনের ১০০ আয়াত তিলাওয়াত করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে ১০০ আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার জন্য পুরো রাত ইবাদতে কাটানোর সওয়াব লেখা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৬,৯৫৮; নাসায়ি, হাদিস: ১০,৪৮৫)
৩. রাতে ঘুমানোর আগে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার নিয়ত করে শোয়া: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার নিয়ত করে ঘুমাতে যায়, এরপর চোখে প্রবল ঘুম থাকার কারণে জাগতে জাগতে ভোর হয়ে যায়, এ জন্য তার নিয়ত অনুসারে সওয়াব লেখা হবে এবং আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে তার ঘুম তার জন্য সদকাস্বরূপ হবে। (নাসায়ি, হাদিস: ১,৭৮৭; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৩৪৪)
৪. ইমামের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে তারাবিহর নামাজ আদায় করা: আবুজর গিফারি (রা.)-এর এক প্রশ্নের উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত নামাজ আদায় করে, তাহলে তাকে পুরো রাত নামাজ আদায়কারী হিসেবে গণ্য করা হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩৭৫; নাসায়ি, হাদিস: ১,৩৬৪)
উল্লিখিত হাদিসের ‘নামাজ’ বলতে কোন নামাজ বোঝানো হয়েছে, এর ব্যাখ্যায় কিছু মুহাদ্দিস বলেছেন, ‘এই হাদিসে নামাজ বলতে রমজানের তারাবিহর নামাজ উদ্দেশ্য। সুতরাং গোটা ব্যাখ্যাটি হবে এমন, যে বক্তি রমজান মাসে রাতের প্রথম ভাগে ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তারাবিহর নামাজ আদায় করবে, সে সারা রাত নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ) আদায়ের সওয়াব প্রাপ্ত হবে।’ (মিরকাতুল মাফাহিত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৮; ফাইজুল কাদিন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩৬)
৫. বিধবা ও মিসকিনদের পাশে দাঁড়ানো: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনদের অভাব দূর করার জন্য সচেষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদের মতো অথবা ওই ব্যক্তির মতো (সওয়াব পাবে), যিনি রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে এবং দিনে রোজা রাখে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫,৩৫৩, মুসলিম, হাদিস: ২,৯৮২)
৬. যথাযথ আদব ও সুন্নত মেনে জুমার নামাজ আদায় করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন (ফরজ গোসলের মতো) ভালোভাবে গোসল করবে, সকাল সকাল (মসজিদের উদ্দেশে) ঘর থেকে বের হবে, কোনো বাহনে না চড়ে পায়ে হেঁটে মসজিদের যাবে, ইমামের কাছাকাছি বসবে এবং কোনো ধরনের অনর্থক কথা না বলে মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনবে; তিনি মসজিদে যাওয়ার প্রতি কদমের বিনিময়ে এক বছর রোজা রাখা এবং রাতভর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৩৪৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,০৮৭)
৭. আল্লাহর রাস্তায় দ্বীনের জন্য পাহারাদারি করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক দিন ও এক রাত আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস যাবৎ রোজা রাখা এবং রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’ (মুসলিম, হাদিস: ১,৯১৩)
মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক