পবিত্র কাবা শরিফ
পবিত্র কাবা শরিফ

হজের প্রস্তুতি: কখন কী করতে হবে

হজ দ্বিরাষ্ট্রীয় ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের কার্যক্রম। সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় হজের যাবতীয় কাজ করা হয়। ঠিকমতো রোডম্যাপ অনুসরণ করা না হলে সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২০২৫ সালের ৫ জুন পবিত্র হজ হতে পারে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। ইতিমধ্যে হজযাত্রী নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধন চলবে।

ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি হজের অত্যধিক গুরুত্ব ও ফজিলতের কারণে প্রত্যেক ইমানদার মুসলমানের মধ্যেই হজ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। অনেকে হজের ব্যয় মেটাতে কষ্টার্জিত অর্থ থেকে তিলে তিলে সঞ্চয় করেন। কেউ কেউ জমিজমা বিক্রি কিংবা শেষ জীবনের সম্বল উজাড় করে হজ পালন করেন। মুমিনদের ঐকান্তিক ইচ্ছা হলো মহান আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমে নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া।

ইসলামি বিধান অনুসারে, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা, হারাম শরিফ ও তৎসংলগ্ন সাফা-মারওয়া পাহাড়ে হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এ জন্য হজ করতে বিভিন্ন দেশের মানুষকে সৌদি আরবে যেত হয়। সৌদিতে যেতে দরকার বৈধ পাসপোর্ট ও হজ ভিসা। ২০২৫ সালে হজ করতে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাসপোর্টের মেয়াদ থাকতে হবে।

চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের হজ নিবন্ধন, চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। ঢাকা হজ অফিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে প্রাক্-নিবন্ধন ও নিবন্ধন করা যাবে।

হজে যাওয়ার মাধ্যম

বাংলাদেশ থেকে দুটি মাধ্যম—সরকারি ও বেসরকারি হজ এজেন্সির মাধ্যমে হজ করা যায়। এ বছর হজে যেতে প্রথমে প্রাক্-নিবন্ধন এবং পরে প্রাথমিক ও সবশেষে চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে হবে। চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের হজ নিবন্ধন, চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। ঢাকা হজ অফিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে প্রাক্‌–নিবন্ধন ও নিবন্ধন করা যাবে। এ ছাড়া, হজের কলসেন্টার ১৬১৩৬ নম্বরে ফোন করে e-Hajj BD মোবাইল অ্যাপ কিংবা www.hajj.gov.bd এই ওয়েব পোর্টালে লগইন করে নিবন্ধন করা যাবে।

তবে দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ক্যানসার, অ্যাডভান্সড কার্ডিয়াক, লিভার সিরোসিস, কিডনি রোগ, সংক্রামক যক্ষ্মা ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া হজে গমনেচ্ছু বাংলাদেশের যেকোনো মুসলিম নাগরিক যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হজে যেতে পারবেন। নিবন্ধনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট, সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি ও হজযাত্রীর ব্যাংক হিসাবের তথ্য প্রয়োজন হবে। প্রাক্‌–নিবন্ধনের জন্য ৩০ হাজার ও প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য তিন লাখ টাকা সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় জমা দিতে হবে। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত তারিখের মধ্যে প্যাকেজ মূল্য পরিশোধ করে চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে হবে। প্রাক্‌-নিবন্ধনকালে জমা দেওয়া ৩০ হাজার টাকার মধ্যে প্রাক্‌-নিবন্ধন প্রক্রিয়া ফি বাবদ ১ হাজার টাকা কেটে বাকি ২৯ হাজার টাকা এবং প্রাথমিক নিবন্ধনের ৩ লাখ টাকা চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় প্যাকেজ মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।

গত ৩০ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ হজ প্যাকেজ-১ ও সাধারণ হজ প্যাকেজ-২ নামে দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ হজ প্যাকেজ-১–এর ব্যয় ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা এবং প্যাকেজ–২–এর ব্যয় ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের ফলে এ বছর উড়োজাহাজের ভাড়া ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমেছে। রাজস্ব বোর্ডও হজযাত্রীদের জন্য বিমান টিকিটের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে।

সৌদি রিয়ালের দাম গতবারের তুলনায় ২ টাকা ৭৬ পয়সা বেড়ে যাওয়ায় সংগত কারণেই হজের খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা। তবে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা যাতে যৌক্তিক ব্যয়ে হজ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে সরকার হজযাত্রীদের আবাসন ও সেবায় কিছুটা পরিবর্তন এনে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ বছর বেসরকারি মাধ্যমের সাধারণ হজ প্যাকেজের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। এ ছাড়া সাধারণ হজ প্যাকেজ গ্রহণপূর্বক এজেন্সিগুলোর জন্য অতিরিক্ত একটি বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলোর দুটি অংশ আলাদাভাবে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

হজ ও ওমরাহ বিধিমালা ২০২২ অনুসারে এজেন্সিগুলো হজযাত্রীদের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে চুক্তি করবে। এ চুক্তিতে মক্কা ও মদিনার বাড়ি বা হোটেলের মান, দূরত্ব ও মিনার তাঁবুর জোন ও সার্ভিস কোম্পানির ব্যয়সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিবরণ অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এজেন্সির হজ প্যাকেজ এজেন্সির নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং ই-হজ সিস্টেমে আপলোড করতে হবে। হজযাত্রীরা বেসরকারি মাধ্যমে হজ পালনে ইচ্ছুক হলে প্যাকেজ মূল্য ও প্রদেয় সেবা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত হজ কার্যক্রমের জন্য ‘নির্ধারিত ব্যাংক হিসাব’ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে টাকা এজেন্সিকে দেওয়া যাবে না।

সৌদি আরবে হজযাত্রীকে নুসুক কার্ড, পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড ও হোটেলের কার্ড সার্বক্ষণিক সঙ্গে রাখতে হবে। সৌদি আরবে অবস্থানকালে রাজনীতি, বিক্ষোভ প্রদর্শন, মানববন্ধন, ভিক্ষাবৃত্তি, চুরিসহ সব ধরনের অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

হজযাত্রীকে বায়োমেট্রিক সম্পন্ন করে ঢাকায় হজ অফিসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বায়োমেট্রিক সনদ ও পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। হজযাত্রীর ভিসা ও পাসপোর্ট ঢাকায় হজ অফিস থেকে যথাসময়ে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে হজযাত্রীর মুঠোফোনে এসএমএস পাঠানো হবে। মক্কা ও মদিনায় ভাড়া করা বাড়ি বা হোটেলের নাম দিয়ে সৌদি ই-হজ সিস্টেমে ভিসা লজমেন্ট করার কারণে বরাদ্দ করা বাড়ি বা হোটেল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

প্রাক্‌-নিবন্ধিত কোনো হজযাত্রী তাঁর নিবন্ধন বাতিল বা এজেন্সি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২২ (সংশোধিত) অনুসরণ করতে হবে। শুধু প্রাক্‌-নিবন্ধিত হজযাত্রীর লিখিত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ই-হজ সিস্টেমে প্রাক্‌-নিবন্ধন বাতিল বা স্থানান্তর করতে পারবে। হজযাত্রীর অনুমতি ছাড়া প্রাক্‌-নিবন্ধন বাতিল বা স্থানান্তর করা হলে তা এজেন্সির অনিয়ম বা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। প্রাক্‌-নিবন্ধন বাতিল ও স্বেচ্ছায় এজেন্সি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রাক্‌-নিবন্ধনকারী এজেন্সি হজযাত্রীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে। তবে কোটা পূরণ, সমন্বয় কিংবা অভিযোগের কারণে হজযাত্রী স্থানান্তর করা হলে, হজযাত্রীর কাছ থেকে কোনো সার্ভিস চার্জ আদায় করা যাবে না।

মসজিদে নববি, মদিনা

শিশুদের নিবন্ধন

শিশুদের নিবন্ধন অভিভাবকের সঙ্গে একসঙ্গে করতে হবে। হজ শেষে শিশু বা নবজাতকের উড়োজাহাজ ভাড়ার ফেরতযোগ্য অংশ পেতে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতার কারণে হজে যেতে সক্ষম না হলে জমা করা অর্থের অব্যয়িত অংশ হজযাত্রীকে ফেরত দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক বিধি অনুসরণ করে হজের সময় প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়া যাবে।

হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি স্বনামধন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে হবে। সেই পরীক্ষার রিপোর্টসহ টিকা কেন্দ্রে গিয়ে মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিয়ে টিকা–সংবলিত স্বাস্থ্যসনদ নিতে হবে। বিমানে ভ্রমণকালে একজন হজযাত্রী সর্বোচ্চ ৪৬ কেজি (২৩+২৩) ওজনের দুটি ট্রলিব্যাগ ও সর্বোচ্চ ৭ কেজি ওজনের একটি হ্যান্ডব্যাগ সঙ্গে নিতে পারবেন। ট্রলিব্যাগে হজযাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, হোয়াটসঅ্যাপযুক্ত মুঠোফোন নম্বর, গাইড, মোনাজ্জেমের মুঠোফোন নম্বর ইত্যাদি ইংরেজিতে লিখতে হবে। সৌদি সরকারের আইন অনুযায়ী, হজযাত্রীর লাগেজে নেশাজাতীয় ওষুধ, তামাকপাতা, জর্দা, গুল, শুঁটকি, গুড়, রান্না করা খাবার, পচনশীল দ্রব্য (ফলমূল, পান, সুপারি) ইত্যাদি পরিবহন নিষিদ্ধ।

ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগের মতো রোগের জন্য প্রেসক্রিপশনসহ নিয়মিত সেবন করতে হয় এমন ওষুধ, স্ট্রিপ ইত্যাদি অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। ঢাকার হজযাত্রীরা ফ্লাইট সময়ের কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা আগে এবং ঢাকার বাইরের হজযাত্রীদের কমপক্ষে এক দিন আগে ঢাকার আশকোনা হজক্যাম্পে উপস্থিত থাকতে হবে। হজক্যাম্প ডরমিটরিতে বিনা মূল্যে থাকা এবং নিজ খরচে ক্যানটিনে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

সৌদি আরবে হজযাত্রীকে নুসুক কার্ড, পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড ও হোটেলের কার্ড সার্বক্ষণিক সঙ্গে রাখতে হবে। সৌদি আরবে অবস্থানকালে রাজনীতি, বিক্ষোভ প্রদর্শন, মানববন্ধন, ভিক্ষাবৃত্তি, চুরিসহ সব ধরনের অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় সে দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজকীয় সৌদি পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কোনো ব্যক্তির কাজে বাধা বা তাঁদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না।

হজ পালনকালে মারা গেলে সৌদি আরবে দাফন করা হয়ে থাকে। হজ শেষে মৃত্যুসনদ ঢাকায় হজ অফিসের মাধ্যমে মৃতের ওয়ারিশ বা বৈধ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাগেজ হারিয়ে গেলে বাংলাদেশ হজ অফিস, জেদ্দা, মক্কা বা মদিনায় সরাসরি বা এজেন্সির মোনাজ্জেম বা গাইডের মাধ্যমে জানাতে হবে। দেশে ফেরার পথে লাগেজ হারানো গেলে এ–সংক্রান্ত তথ্য বিমানবন্দরের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ সেকশনে জানাতে হবে। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় মেডিকেল সেন্টার থেকে হজযাত্রীরা বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে খাওয়ার পানি, হ্যান্ডওয়াশ/সাবান ও টয়লেট পেপার নিজ ব্যবস্থাপনায় কিনতে হবে।

১৪৪৬ হিজরির ২৫ জিলকদের পরে কোনো হজযাত্রী মক্কা কিংবা জেদ্দা থেকে সড়কপথে মদিনায় যেতে পারবেন না। ৫ জিলহজের পর কোনো হজযাত্রী পবিত্র মদিনায় থাকতে পারবেন না। হজের পরে ১৪ জিলহজের আগে কোনো হজযাত্রী মক্কা থেকে মদিনায় যেতে পারবেন না।

হজ পালনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এগোলে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সহজ ও সাবলীলভাবে শেষ করা যায়।

জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়