নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ শুরু করল। পুরো মক্কায় সে সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে গেল, সব মানুষের মুখে এই কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। তারপর আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে আদেশ দিলেন, যে সত্য তিনি লাভ করেছেন, তা প্রকাশ্যে প্রচার করার জন্য। আল্লাহ্র পথে সবাইকে আহ্বান করার জন্য। তিন বছর রাসুলে করিম (সা.) সে কথা গোপন করেছিলেন। তারপর আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর ধর্ম প্রচারের হুকুম দিলেন। আর আল্লাহ্ বললেন, ‘এবং তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে প্রচার করো এবং অংশীবাদীদের উপেক্ষা করো।’ তারপর আবার বললেন, তোমার পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দাও, যেসব অনুসারী তোমাকে অনুসরণ করছে, তাদের সঙ্গে এক হয়ে নাও। অন্যত্র, ‘বলো, আমি স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি।’
নামাজ পড়ার জন্য রাসুলে করিমের (সা.) সঙ্গীরা চলে যেতেন পাহাড়ের কাছে, যাতে নামাজের সময় কেউ তাঁদের না দেখে। একদিন সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস কয়েকজন সাহাবি (রাসুলের সঙ্গী) সমেত নামাজ পড়ছিলেন মক্কার এক সঙিন উপত্যকায়। ওখানে এসে চড়াও হলো একদল পৌত্তলিক। তারা তাঁদের বাধা দিল। নামাজের জন্য তারা তাঁদের খুব গালমন্দ করল। কথা-কাটাকাটি হতে হতে একপর্যায়ে তা হাতাহাতি ও মারামারিতে গড়াল। সাদ একজন পৌত্তলিককে উটের চোয়ালের এক হাড্ডি দিয়ে আঘাত করলেন—লোকটা তাতে আহত হলো, আঘাতের স্থান থেকে রক্ত নির্গত হলো।
ইসলামে সে-ই ছিল প্রথম রক্তপাত।
প্রকাশ্যে রাসুলে করিম (সা.) যখন ইসলাম প্রচারে ব্রতী হলেন আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী, তখন তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁকে কোনো বাধা দেয়নি, কিংবা শত্রুতা করেনি। যত দূর আমি শুনেছি—বাধা দিয়েছে তখন, যখন রাসুলে করিম (সা.) তাদের উপাস্য দেবদেবীর অসারতা সম্পর্কে উক্তি করতে শুরু করলেন। তাদের দেবদেবী সম্পর্কে অশ্রদ্ধা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা সবাই তাঁকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল। ইসলামের সাহায্যে আল্লাহ্ যাঁদের রক্ষা করলেন, তাঁরা ছিলেন মাত্র অল্প কয়েকজন। তাঁরা ছাড়া আর সবাই শত্রু হলো নবী করিম (সা.)-এর। পিতৃব্য আবু তালিব রাসুলে করিমকে (সা.) আগের মতোই স্নেহ করে যেতে লাগলেন, তাঁকে সব রকমের সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যেতে লাগলেন। রাসুল (সা.) আল্লাহ্র নির্দেশও মেনে চলতে লাগলেন, কোনো কিছুই থেকে তাঁকে বিরত করতে পারল না।
কোরাইশরা যখন দেখল কিছুতেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না তাঁকে, তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন নবী, তাদের দেবদেবীদের অপমান করে যাচ্ছেন, তাঁর চাচা প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাঁকে, তাঁকে আশ্রয় দিচ্ছেন, সমর্থন দিচ্ছেন, তাদের খাতিরে কিছুতেই তাঁকে ত্যাগ করছেন না, তখন ওরা সবাই সদলবলে গেলেন আবু তালিবের কাছে। যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল উতবা ও শায়বা। উভয়েই রাবিয়া ইবনে আবদ শামসের ছেলে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব আবুল বাখতারি, যার পুরো নাম ছিল আল-আস ইবনে হিশাম ইবনে আল-হারিস ইবনে আসাদ, আল আসওয়াদ ইবনে আল মুত্তালিব ইবনে আসাদ, আবু জেহেল (এর অন্য নাম আমর, উপাধি ছিল আবুল হাকাম) ইবনে হিশাম ইবনে আল মুগিরা, আল ওয়ালিদ ইবনে আল মুগিরা, নুবাই ও মুনাব্বিহ উভয়েই আল-হাজ্জাজ ইবনে আমির ইবনে হুজায়ফার ছেলে এবং আল-আস ইবনে ওয়াইল।
তাঁরা বললেন, ‘হে আবু তালিব! আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের দেবতাদের অভিসম্পাত দিয়েছে, আমাদের ধর্মকে অপমান করেছে, আমাদের জীবনধারাকে উপহাস করেছে, বলেছে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভুল করেছে। আপনি এর বিহিত করুন, আর না হয় আমাদের ওপর এর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিন। কারণ, আপনিও আমাদের মতোই প্রতিপক্ষের লোক। আমরা ওকে মিসমার করে দেব।
আপসের ভাষায় কথা বললেন আবু তালিব। তাদের বোঝালেন খুব নরম ভাষায়। তিনি বললেন, তিনি দেখবেন কী করা যায়। তারা তাঁর কথা মেনে চলে গেল।
রাসুলে করিম (সা.) তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আল্লাহ্র ধর্ম প্রকাশ্যে প্রচার করে যেতে লাগলেন, সবাইকে আল্লাহ্র পথে আসার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। ফলে কোরাইশদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও খারাপ হতে লাগল। তাঁর বন্ধুরা সব শত্রু হয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। ওরা ভীষণ বলাবলি করতে লাগল তাঁর কথা, একজনকে আরেকজন উসকানি দিতে লাগল।
ওরা আবার গেল আবু তালিবের কাছে। বলল, ‘আপনাকে আমরা সবাই মানি। আমাদের মুরব্বি আপনি। আপনার ভাতিজার কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য আমরা এসেছিলাম আপনার কাছে, আপনি কিছুই করেননি। বলে, আমাদের বাপ-দাদারা সব খারাপ ছিল, আমাদের চালচলনকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে, আমাদের দেবদেবীদের অপমান করে ওরা। ঈশ্বরের কসম, আপনি ওর সম্পর্কে একটা কিছু করবেন, না হয় আমরা আপনাদের দুজনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। হয় আপনারা থাকবেন, না হয় আমরা থাকব। ঠিক এই ভাষায় না হোক, এমনই কথা ওরা এসে বলল আবু তালিবকে বলেই তারা চলে গেল।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে