দুই দেশেরই ইমিগ্রেশন ঢাকাতে

আমাদের হজ ফ্লাইট বিজি-৩০১৯ বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা থেকে রাত সোয়া এগারোটায়। সেটা ২০২৩ সালের ২ জুন শুক্রবার। আগের দিন মোবাইল ফোনে এই খুদে বার্তা পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকরিয়া করলাম।

আসলে ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০০৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ। দৈনিক পত্রিকা অফিসে এদিন অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের ওপর রীতিমতো ঝড় বয়ে যায়। তাই বিধ্বস্ত অবস্থায় রাত ১১টায় বাসায় ফেরা। তবে বিশ্রামের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে থাকায় উদ্বেগ তেমন ছিল না। পরদিন মানে শুক্রবার জুম্মার আগেই ব্যাগ ও সুটকেস গুছিয়ে বাধাছাদা শেষ করা গেল। আমার সহধর্মিণীর ছোট বোন আফসানা ও তাঁর স্বামী মারুফ আমাদের সব রকম সহযোগিতা করছিল। ওদের ১০ বছরের কন্যা সৌদামিনী সারাক্ষণ আমাদের এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছিল। এদিক সকালে আমার শাশুড়ি এসে আমাদের দোয়া করে গেলেন।

জুম্মার নামাজ আদায় করে বাসায় এসে দুপুরের খাওয়া সারলাম। এ সময় এলেন আমার আম্মা। তিনি আমাদের দোয়া করে গাড়িতে তুলে বিদায় জানালেন। আমাদের বাসভবনের কেয়ারটেকার মোস্তফাই গাড়ি ঠিক করা ও মালপত্র তুলে দেওয়ার কাজ করে দিয়েছে।

দুই.

ছুটির দিনে রাস্তায় কোনো যানজট না থাকায় হজ ক্যাম্পে বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম। আমাদের গাইড আক্তার ভাই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সফরসঙ্গী মজনু ভাইর কাছে আমাদের পাসপোর্ট ও টিকিট রয়েছে। তিনি দু’দিন আগে সিলেট থেকে এসে হজক্যাম্পে উঠেছেন। তাঁর কাছ থেকে পাসপোর্ট ও টিকিট সংগ্রহ করে ক্যাম্পের মসজিদের ভেতরে আসরের সালাত আদায় করলাম। মসজিদের একজন খাদেমের সহায়তায় ইহরামের লেবাস পরিধান করে নিলাম। তারপর আসরের ফরজ নামাজ আদায় করলাম।

ইহরামের লেবাস হলো দুই টুকরো সেলাইবিহীন সাদা কাপড় যার একটা শরীরের নিচের অংশে পেঁচিয়ে রাখতে হয়, আরেকটা দিয়ে শরীরের ওপরে অংশ ঢাকতে হয়। আর পায়ে রাখতে হয় দুই ফিতার চপ্পল। তার আগে প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিচ্ছন্নতা বাসা থেকেই সেরে এসেছি। আমি টাওয়ালের লেবাস গায়ে চাপিয়েছিলাম। কারণ, বিমানবন্দরে, বিমানে ও বাসে এসির মধ্যে থাকতে হবে। টাওয়ালে ঠান্ডা একটু কম লাগে। ইহরামের লেবাস পড়লেও তখন ওমরাহর নিয়ত করিনি। আমরা যেহেতু তামাত্তু হাজি তাই প্রথমে ওমরাহর নিয়ত করতে হবে। তা্মত্তু হাজিরা প্রথমে ওমরাহ করেন। তারপর হালাল হয়ে পরে যথাসময়ে হজের নিয়তে আবার ইহরাম বাধেঁন। মহিলাদের আলাদা কোনো ইহরামের লেবাস নেই। শরীয়তসম্মতভাবে পর্দা হবে এমন যে কোনো পোশাকই তাঁদের ইহরামের লেবাস।

ওদিকে আমার সহধর্মিণী কর্তব্যরত স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় একটা ট্রলি সংগ্রহ করে সুটকেস ও ব্যাগ তুলে ফেলেছে। খুব ভালো লাগল যে হাজিদের সহযোগিতার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া দেখে। তারাও বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে হাজিদের খেদমত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

বিমানের চেকইন কাউন্টারে করার আগে গাইডের কাছ থেকে নির্ধারিত রঙের লাগেজ ট্যাগ নিয়ে তা লাগাতে হলো সুটকেস ও ব্যাগে। এই রঙের ট্যাগ দিয়েই আমাদের মালপত্রগুলো মক্কায় আমাদের নির্ধারিত বাড়িতে পাঠানোর জন্য চিহ্নিত করা হয়। আমাদের জন্য নির্ধারিত ছিল চকলেট রঙের ট্যাগ। রুট টু মক্কা কর্মসূচির আওতায় হজ ক্যাম্পে বিমানের চেক-ইন সম্পন্ন করে বোর্ডিং পাস নেওয়ার পর ওখানেই বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়ে গেল। প্রতিটা ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আমাদের কাছে দোয়া চেয়েছেন।

আমাদের নির্ধারিত ফ্লাইটের সবার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর নির্ধারিত কয়েকটি বাসে করে আমাদের নিয়ে আসা হলো ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। হাজিদের বহনকারী বাসগুলো দ্রুত যেন যেতে পারে, সে জন্য রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও অন্য সব যানবাহন থামিয়ে পার করে দিয়েছে। এভাবে প্রতিটি ধাপে আল্লাহর মেহমানদের জন্য সবাই যে যার জায়গা থেকে সহযোগিতা করেছেন।

বিমান বন্দরে প্রবেশ করার পর ইউনিমার্টের সৌজন্যে আমাদের জন্য খাবার ও পানি দেওয়া হলো। আমরা দক্ষিণ দিকে গিয়ে নামাজের স্থানে মাগরিবের সালাত আদায় করে নিলাম। তারপর খাবার খেলাম। ঘণ্টাখানেক পরে ডাক পড়ল। বিমানবন্দরের একেবারে উত্তর প্রান্তে ১১ ও ১২ নম্বর ফটকের প্রাঙ্গণে অস্থায়ী সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন বুথ বসানো হয়েছে। স্থানটুকুর নিয়ন্ত্রণ সৌদি কর্মকর্তাদের হাতে। ওখানে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বাস্তবে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও কাগজপত্রে সৌদি আরবে প্রবেশ করে গিয়েছি। রোড-টু-মক্কা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশি হাজিরা এই সুবিধাটা পেয়েছেন।

ইমিগ্রেশন বুথ পেরিয়ে গিয়ে আবার অপেক্ষা। ওখানেই ইশার সালাত আদায় করলাম। তবে মহিলাদের জন্য সালাতের স্থান খুবই ছোট হওয়ায় তাদের খানিকটা অসুবিধাই হয়েছে।

অবশেষে বিমানে ওঠার ডাক এল। ৪১৯ জন হাজি আমরা। এদের মধ্যে প্রথমবার উড়োজাহাজে চাপতে যাচ্ছেন, এমন যাত্রী নেহাতই কম নন। আছেন অনেক বয়স্ক নারী ও পুরুষ। ফলে সবাইকে ঠিকঠাকমতো যার যার আসনে বসাতে গিয়ে বিমান কর্মীদের একটু বাড়তি তকলিফ করতেই হলো। ঢাকার মাটি ছেড়ে ‘রাঙা প্রভাত’ আকাশে উঠে যাওয়ার একটু পরেই দেওয়া হলো রাতের খাবার। ততক্ষণে শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। কাজেই খাওয়া সেরে চোখ মুদতে তেমন অসুবিধা হলো না। তবে পুরোপুরি নয়, ভেঙে ভেঙে ঘুমাচ্ছিলাম। যাত্রাপথের মাঝামাঝিতে টয়লেট সেরে এলাম।

এর একটু পরেই ঘোষণা করা হলো যে আমরা শিগগির মিকাত পার হতে যাচ্ছি। তামাত্তু হাজি হিসেবে ওমরাহর নিয়ত করলাম ‘লাব্বাইকা ওমরাহ’ বলে। তারপর নিচু স্বরে তালবিয়া পাঠ করতে লাগলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই পুরো উড়োজাহাজে ধ্বনিত হতে থাকল: ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা- শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়ামাতা, লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাক।’ (আমি হাজির! হে আল্লাহ, আমি হাজির! তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি হাজির! তোমার কোনো অংশীদার নেই। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির! সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামতসমূহ ও একচ্ছত্র রাজত্ব তোমারই, তোমার কোনো অংশীদার নেই।}

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক