মক্কার রাজনৈতিক পদক্ষেপ
অনুসারী গঠন: মক্কার ১৩ বছরে আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী ও আবুযর গিফারি (রা.)-র মতো বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং মক্কার ৪৩৫, মদিনার ২০০ এবং হাবশায় হিজরতকারী প্রায় ১০০ লোকসহ মোট সাড়ে সাত শতাধিক ব্যক্তিকে মহানবী (সা.) ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসেন। হিজরতের পর এই সংখ্যাটি এক বছরে প্রায় চার গুণ বেড়ে তিন হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়।
দপ্তর প্রতিষ্ঠা: মক্কায় অনুসারীদের প্রশিক্ষণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি কাবা শরিফের পাশে আরকাম ইবনে আবুল আরকাম (রা.)–র বাড়িতে একটা কেন্দ্রীয় দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এটিকে রাজনৈতিক আশ্রয়কেন্দ্রও বলা চলে। এখানে গোপনে এসে নতুন ধর্মান্তরিতরা যাবতীয় কর্মসূচীর সংবাদ সংগ্রহ করতে পারতেন। প্রাথমিক শিক্ষা, নতুন খোদায়ি বিধান এবং নবীজির (সা.) নির্দেশনার কথাও জানতে পারতেন।
আবিসিনিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে পাঠানো: তিনি যখন দেখলেন, তাঁর অনুসারীদের কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হচ্ছে এবং জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠেছে, তখন তাঁদের আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) চলে যেতে বলেন। তিনি নিজে মক্কায় থেকে যান। সাহাবিদের ১০ জনের একটি দল (পরে তা বেড়ে ৮৩ জনে পৌঁছে) আবিসিনিয়ায় হিজরত করে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। পরে মদিনা মুসলিমদের আবাসভূমি হয়ে উঠলে তারা মদিনায় চলে আসেন। আবিসিনিয়া হিজরতে মাধ্যমে কেবল কোরাইশের নিপীড়ন থেকে তাঁরা মুক্তিই পান না, ইসলামের প্রসারও হয় এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গেও মহানবী (সা.)-র অনুসারীদের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র তৈরি হয়।
মদিনাবাসীর সঙ্গে চুক্তি: হজের মৌসুমে ইয়াস্রিবের (মদিনার পুরোনো নাম) অধিবাসীরা মক্কায় এলে মহানবী (সা.) তাদের সামনে ইসলাম তুলে ধরেন। তারাও নিজেদের অনৈক্যের কথা নবীজিকে জানান। তারা আশা করেন, তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ আরব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। গভীর রাতে তারা আকাবার কাছে একটি গিরিপথে সমবেত হন। দুজন নারীসহ সংখ্যায় ছিলেন তারা ৭৩ জন। নবীজির সঙ্গে চাচা আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবও ছিলেন। তারা প্রতিশ্রুতি দেন নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের সুরক্ষায় তারা ততটা যত্নবান নবীজির বেলায়ও ততটাই হবেন। নবীজিও বলেন, তাদের নিঃসঙ্গ ও সহায়হীন অবস্থায় ছেড়ে না দিয়ে তাদেরই একজন হয়ে থাকবেন। তারা যার সঙ্গে যুদ্ধ করবে, তিনিও তার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন; যার সঙ্গে সন্ধি করবে, তিনিও তার সঙ্গে সন্ধি করবেন। এই প্রতিশ্রতি মদিনায় নবীজির অবস্থান এবং ইসলামের প্রাথমিক ভিত শক্তিশালী করে দেয়।
প্রাথমিক জরিপ: বুখারির কিতাবুল জিহাদ-এ উল্লেখ আছে, দ্বিতীয় হিজরিতে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে নবীজি (সা.) মুসলিম জনগণের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করে একটি দপ্তরে সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন। এটি একটি প্রয়োজনীয় জরিপকার্য বটে। ইতিহাসে এটিই প্রথম লিপিবদ্ধ আদমশুমারি।
মসজিদ নির্মাণ: নবীজি (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে (২৪ সেপ্টেম্বর, ৬২২ ইসায়ি) সর্বপ্রথম মসজিদে নববি নির্মাণ করেন। এটা একদিকে ছিল যেমন ইবাদাতের ঘর, তেমনি ছিল তার কর্মী ও সহচরদের পারস্পরিক সম্মিলনকেন্দ্রও।
আনসার ও মুহাজির ভ্রাতৃবন্ধন: মক্কা থেকে গমনকারী ও মদিনায় অভ্যর্থনাকারী উভয়পক্ষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে তিনি একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। মক্কাবাসীদের বলা হতো মুহাজির এবং মদিনাবাসী আনসার। তাদের মিত্রতা তিনি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অঙ্গীকারেও বেঁধে দেন। এই ভ্রাতৃবন্ধন পরের সব সম্মিলিত কর্মতৎপরতা নির্বিবাদে এগিয়ে নিতে প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
আওস-খাজরাজের বিরোধ মীমাংসা: মদিনার প্রধান দুটি গোত্র আওস ও খাজরাজের মধ্যেও প্রায়ই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল ‘বুয়াস’ যুদ্ধ। এ যুদ্ধটি হয় হিজরতের ৫ বছর আগে। আওস ও খাজরাজ গোত্রের বহু দিনের বিবাদ মিটিয়ে মহানবী (সা.) মদিনায় বসবাসকারী তিনটি শ্রেণির মধ্যে ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ‘মদিনার সনদ’ প্রণয়ন করেন।
মদিনা সনদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে ‘মদিনা সনদ’ পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মসৃণ পাতলা চামড়ায় লিখিত এ সনদটি দীর্ঘকাল সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নেতাদের কাছে ছিল। পরে তা হাদিস গ্রন্থগুলোতে সংরক্ষিত হয়েছে। এতে মহানবী (সা.) কুরআনের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে একটি লিখিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এ সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। এতে ধর্ম–বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে তিনি রাজনৈতিক ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এবং মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তোলার তাগিদ দেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ: মদিনায় মহানবী (সা.)–র ১০ বছরের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন বিবদমান গোত্রগুলো একটি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় নিয়ে আসা, বিভিন্ন এলাকা ও গোত্রের ২০৯টি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ ও সংলাপ, রাজনৈতিক লক্ষ্যে শতাধিক দূত প্রেরণ, তৎকালের দুই পরাশক্তি পারস্য ও রোম সম্রাটসহ চার শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে চিঠি পাঠানো, বিদ্রোহীদের দমন, বৈরী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ নানান রাজনৈতিক ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেন। এর ফলাফলও এসেছিল দ্রুত। মাত্র ১০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা ৭০০ থেকে প্রায় ১০ লাখে উন্নীত হয়। মাত্র ছয় বর্গমাইলের ইসলামি অঞ্চলের পরিধি পৌনে ১২ লাখ বর্গমাইলে বিস্তৃতি লাভ করে। বিদায় হজেই অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সোয়া লাখের ওপরে।