সুরা কাহাফে একসঙ্গে হজরত মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)

পবিত্র কোরআনের ১৮ তম সুরা আল কাহাফ। কাহাফ মানে গুহা। এ সুরার আয়াত সংখ্যা ১১০। মক্কায় অবতীর্ণ এই সুরায়, গুহাবাসীদের বিবরণ স্থান পেয়েছে। সরল পথের আলোচনা করে মোহাম্মদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) খিজির (আ.)–এর সঙ্গে সফর করার সময় তিনটি ঘটনা সংঘটিত হয়।

প্রথম ঘটনায় খিজির (আ.) একটি নৌকা ছিদ্র করে ফেলেন, অথচ নৌকার মালিক বিনা ভাড়ায় তাঁকে নৌকায় উঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনায় তিনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেন। তৃতীয় ঘটনায় তিনি একটি দেয়াল উঠিয়ে দেন।  ঘটনা তিনটি দেখে হজরত মুসা (আ.) চুপ থাকতে পারলেন না। তখন খিজির (আ.) ঘটনাগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। হজরত মুসা (আ.) বুঝতে পারলেন আল্লাহ কীভাবে কাউকে কাউকে অন্তর্দৃষ্টি দেন, যাতে তাঁরা সুদূরপ্রসারী অর্থে এমন কাজ করতে পারেন যাকে আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য বলে মনে হয় না।

সব জ্ঞানের অধিকারী কেবলই আল্লাহ। তাই জ্ঞান নিয়ে অহংকার করা অনুচিত।

এ সুরায় দুটি কাহিনি এসেছে ৬০ থেকে ১০১ আয়াতে। সে দুটি হলো মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) ঘটনা। কোরআনে আছে,  আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন মুসা তার সঙ্গীকে বলেছিল, 'দুই সমুদ্রের মধ্যে না পৌঁছে আমি থামব না-আমি বছরের পর বছর চলতে থাকব।’ ওরা যখন দুইয়ের সংগমস্থলে পৌঁছল তখন ওরা ভুলে গেল (সেই) মাছের কথা যে সুড়ঙ্গের মতো পথ ক'রে সমুদ্রের মধ্যে নেমে গেল। ওরা যখন আরও দূরে গেল তখন মুসা তার সঙ্গীকে বলল, 'আমাদের সকলের খাবার আনো। আমাদের এ-যাত্রায় আমরা তো কাহিল হয়ে পড়েছি।'

সে বলল, 'তুমি কি লক্ষ করেছিলে, আমি যখন এক পাথরের ওপর বিশ্রাম করছিলাম তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম? শয়তানই ওর কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটা আশ্চর্যরকমভাবে সমুদ্রে নিজের পথ ক'রে নিল।'

মুসা বলল, 'আমরা তো এ-জায়গারই খোঁজ করছিলাম।' তারপর তারা নিজেদের পায়ের চিহ্ন ধ'রে ফিরে চলল। তারপর ওদের দেখা হলো আমার অন্যতম দাসের সঙ্গে যাকে আমি আমার অনেক অনুগ্রহ দান করেছিলাম। ও যাকে আমি নিজ থেকে জ্ঞানদান করেছিলাম। মুসা তাকে বলল, 'সত্য পথের যে-জ্ঞান তোমাকে দেওয়া হয়েছে তার থেকে আমাকে শিক্ষা দেবে, এইশর্তে কি আমি তোমাকে অনুসরণ করব?' সে বলল, 'তুমি কিছুতেই আমার সঙ্গে ধৈর্য রাখতে পারবে না। যে-বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে-বিষয়ে তুমি কেমন করে ধৈর্য ধরবে?' মুসা বলল, 'আল্লাহ্ চাইলে তুমি আমাকে ধৈর্য ধরতে দেখবে আর তোমার কোনো আদেশ আমি অমান্য করব না।'সে বলল, 'আচ্ছা, তুমি যদি আমাকে অনুসরণ করই তবে আমাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন কোরো না, যতক্ষণ না আমি সেই সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলি।'

তারপর ওরা চলতে লাগল, যখন ওরা নৌকায় উঠল তখন সে তাতে ফুটো করে দিল। মুসা বলল, 'তুমি কি সওয়ারিদেরকে ডোবানোর জন্য ওর মধ্যে ফুটো করলে? এ তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলে।' সে বলল, 'আমি কি বলিনি যে তুমি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারবে না?' মুসা বলল, 'আমার ভুলের জন্য তুমি আমার অপরাধ ধরবে না, আর আমার ওপর আর বেশি কঠোর হবে না।'  তারপর ওরা চলতে লাগল। চলতে চলতে ওদের সাথে এক ছেলের দেখা হলো। সে ওকে খুন করল। তখন মুসা বলল, 'তুমি এক নিষ্পাপ লোককে খুন করলে যে কাউকে খুন করেনি। তুমি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলে।’  সে বলল, 'আমি কি বলিনি তুমি কিছুতেই আমার সঙ্গে ধৈর্য রাখতে পারবে না?' মুসা বলল, 'এর পর যদি আমি তোমাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করি তবে তুমি আর আমাকে সাথে রাখবে না। আমার ওজর-আপত্তি শেষ হয়েছে।' তারপর ওরা চলতে লাগল। যখন ওরা এক জনপদের বাসিন্দাদের কাছে পৌছুল তখন তারা তাদের কাছে কিছু খাবার চাইল; কিন্তু তারা ওদের আতিথেয়তা করতে রাজি হলো না। তারপর সেখানে ওরা একটা পড়ন্ত দেওয়াল দেখতে পেল, কিন্তু মুসার সঙ্গী ওটাকে শক্ত করে দিল। মুসা বলল, 'তুমি ইচ্ছা করলে অবশ্যই এর জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারতে।' মুসার সঙ্গী বলল, 'এখানেই তোমার ও আমার সম্পর্কচ্ছেদ হলো।

যে-বিষয়ে তুমি ধৈর্য রাখতে পারনি আমি তার অর্থ বলে দিচ্ছি।  নৌকার ব্যাপার-সেটা ছিল কয়েকজন গরিব লোকের, ওরা সাগরে তাদের জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করে নৌকাটায় ত্রুটি ঢুকিয়ে দিলাম, কারণ ওদের সামনে ছিল এক রাজা যে জোর করে সব নৌকা ছিনিয়ে নিত।  আর ছেলেটির বাবা-মা ছিল বিশ্বাসী। আমার আশঙ্কা হয়েছিল তার অবাধ্যতা ও অবিশ্বাস তাদেরকে বিব্রত করবে।  তারপর আমি চাইলাম যেন তার পরিবর্তে ওদের প্রতিপালক ওদেরকে এক সন্তান দেন যে পবিত্রতায় হবে আরও বড় ও ভক্তি-ভালোবাসায় হবে আরও অন্তরঙ্গ।  আর এ-দেওয়ালটি ছিল শহরের দুই এতিমের। তার নিচে ছিল গুপ্তধন। আর ওদের পিতা ছিল এক সৎকর্মপরায়ণ লোক। সেজন্য তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলেন যে, ওরা যেন সাবালক হয় ও তারপর ওরা ওদের ধন উদ্ধার করে। আমি নিজ থেকে কিছু করিনি। তুমি যে-বিষয়ে ধৈর্য রাখতে পারনি এটাই তার ব্যাখ্যা।’ ওরা তোমাকে জুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, 'আমি তোমাদের কাছে তার কথা বয়ান করব।' আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পথনির্দেশ করেছিলাম। সে এক পথ অবলম্বন করল।

চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তাচলে পৌছাল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলে অস্ত যেতে দেখল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, 'হে জুলকারনাইন। তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার বা এদের সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।' সে বলল, 'যে-কেউ সীমালঙ্ঘন করবে আমি তাকে শাস্তি দেব, তারপর তাকে প্রতিপালকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে ও তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। তবে যে বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তার জন্য প্রতিদান হিসেবে আছে কল্যাণ ও তার সাথে ব্যবহার করার সময় আমি সহজভাবে কথা বলব।' আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে যখন অরুণাচলে পৌঁছল তখন সে দেখল তা (সূর্য) এমন এক সম্প্রদায়ের ওপর উঠছে যাদের জন্য সূর্যের তাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমি কোনো আড়াল সৃষ্টি করিনি।. প্রকৃত ঘটনা এই, তার বিবরণ আমি ভালো করে জানি। আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে সে যখন পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে পৌঁছুল তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। (সুরা সুরা কাহাফ, আয়াত ৬০ থেকে ৯৩)