রিজিক মানে শুধু ধনসম্পদে সচ্ছল হওয়া নয়, রিজিকের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ রিজিক বলতে শুধু ধনদৌলত, অর্থাৎ আর্থিক সচ্ছলতা বোঝেন। সমাজে যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তাঁদের বেশি রিজিকপ্রাপ্ত এবং যাঁরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাঁদের কম রিজিকপ্রাপ্ত ভাবা হয়। অথচ ধনসম্পদ বা টাকাপয়সা হলো রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর।
রিজিকের আরও বেশ কিছু স্তর রয়েছে, সেগুলো হলো—
সর্বনিম্ন স্তর
রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর হলো আর্থিক সচ্ছলতা। এটাই একমাত্র স্তর নয়; রিজিক বলতে শুধু ধনসম্পদ, টাকাপয়সায় সচ্ছলতা অর্জন—এমনটি বোঝা এবং এমন বুঝের ওপর অটল থাকা অজ্ঞতার পরিচায়ক। রিজিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, দুনিয়াতে যা কিছু মানুষকে উপকৃত করে, সবই রিজিক। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ধনসম্পদ আর সন্তানসন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৪৬)
আমরা যে ধনসম্পদ উপার্জনের জন্য লালায়িত থাকি, পবিত্র কোরআন ও হাদিসে তাকে ফিতনা ও পরীক্ষা বলা হয়েছে। রিজিকের প্রথম ও প্রধান স্তর ভেবে যা অর্জনের নেশায় ডুবে থাকি, প্রকৃত অর্থে তা রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর ও শোভামাত্র। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘জেনে রাখো! নিশ্চয়ই তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি ফিতনা বা পরীক্ষা। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিতনা রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো ধনসম্পদ।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৭৪৭১)
সর্বোচ্চ স্তর
রিজিকের সর্বোচ্চ স্তর হলো শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘এবং আমি যখন অসুস্থ হই; তখন তিনিই (আল্লাহ) আমাকে সুস্থতা দান করেন।’ (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ৮০)
ইবনে আব্বাস (রা.)–এর বিবরণে আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন দুটি নিয়ামত রয়েছে, বেশির ভাগ মানুষ যার ব্যাপারে ধোঁকায় পতিত—সুস্বাস্থ্য ও অবসর।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৪১২; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪১৭০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্থতাকে উৎকৃষ্ট নিয়ামত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা অর্থসম্পদের চেয়েও মূল্যবান নিয়ামত। তিনি আরও বলেন, ‘তাকওয়ার অধিকারী (খোদাভীরু) মানুষদের ধনসম্পদের মালিক হওয়াতে কোনো দোষ নেই। আর খোদাভীরু মানুষের জন্য সুস্থতা ধনসম্পদের চেয়ে অধিক উত্তম। মনের প্রফুল্লও নিয়ামতরাজির অন্তর্ভুক্ত।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১৪১)
সর্বোত্তম স্তর
রিজিকের সর্বোত্তম স্তর হলো পুণ্যবতী স্ত্রী ও নেককার সন্তানসন্ততি। একজন স্বামীর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুণ্যবতী স্ত্রী। একইভাবে একজন স্ত্রীর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুণ্যবান স্বামী। নারীর সংস্পর্শ ছাড়া কোনো পুরুষের জীবন এবং পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া কোনো নারীর জীবন পূর্ণতা লাভ করে না। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী যদি পুণ্যবতী হন এবং স্বামী যদি হন পুণ্যবান, স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় সংসার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পার্থিব জগৎ হলো ক্ষণিকের উপভোগের বস্তু। আর পার্থিব জগতের সর্বোত্তম সম্পদ হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৬৫৬৭)
পুণ্যবতী স্ত্রীর পাশাপাশি নেক সন্তান বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার সর্বোত্তম উপহার। আল্লাহ তাআলা সুসন্তানকে দুনিয়ার শোভা বলে ইরশাদ করেছেন, ‘ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৪৬)
প্রত্যেক মা-বাবা একটি বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করে থাকবেন—সুসন্তান মানে পরিবারের স্বস্তি। মা–বাবার চক্ষু শীতলকারী সন্তানসন্ততি মানে সুখ। আর এ সুখই হলো রিজিকের সর্বোত্তম স্তরের অংশবিশেষ।
পরিপূর্ণ স্তর
রিজিকের পরিপূর্ণ স্তর হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। প্রত্যেক মুমিন-মুসলিম বান্দার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ৭২)
আবু উমামা আল বাহেলি (রা.)–এর বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা শুধু ওই আমল কবুল করবেন, যা শুধু তাঁর জন্য করা হবে এবং যে আমল দ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে।’ (নাসায়ি, হাদিস: ৩১৪০)
আবশ্যক স্তর
রিজিকের আবশ্যক স্তর হলো ইমান। মুসলিমের জীবনে ইমান অর্জনের চেয়ে বড় কোনো রিজিক ও নিয়ামত নেই। ইমানের নিয়ামত যাদের অর্জন হয়েছে, সৌভাগ্যবান তারা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তারা ইসলাম গ্রহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করেছ মনে কোরো না; বরং আল্লাহ তাআলাই ইমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১৭)
উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস (যিনি এক ও অদ্বিতীয়) নিয়ে যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করবে; সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৬)
অন্যান্য স্তর
কোনো কোনো গবেষক কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনার আলোকে জ্ঞান বা হিকমা অর্জন করা এবং মুমিন বান্দাদের ভালোবাসা প্রাপ্তিকেও রিজিকের স্তর হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়, নিশ্চয়ই তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হবে। জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ এটা উপলব্ধি করতে পারে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)
মুমিন বান্দার প্রতি মুমিন বান্দার ভালোবাসাও এক প্রকার রিজিক বা নিয়ামত। কারণ, আল্লাহ তাআলা যে বান্দাকে ভালোবাসেন, তার প্রতি ইমানদারদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিব্রাইল (আ.)–কে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি; তাই তুমিও তাকে ভালোবাস। কাজেই জিব্রাইল (আ.) তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) আসমানে ঘোষণা করে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালোবাসেন এবং পৃথিবীবাসীদের মধ্যেও তাকে গ্রহণীয় বানানো হয়।’ (বুখারি, হাদিস: ৭৪৮৫)
মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক