নবুয়তের কাহিনি ১

কোরআন অবতীর্ণ হলো

রমজান মাসে রাসুলে করিম (সা.) ওহি পেতে শুরু করলেন। আল্লাহ্‌র ভাষায়, ‘মানুষের জন্য দিকনির্দেশ হিসেবে এবং চূড়ান্ত নীতি নিয়ামক হিসেবে রমজান মাসে কোরআন নাজিল হলো।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি একে অবতীর্ণ করেছি মহিমময় রজনীতে। তুমি কি জানো, সে মহিমময় রজনী কী? মহিমামণ্ডিত সেই রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রাতে প্রভুর অনুমতি নিয়ে ফেরেশতারা নেমে আসেন। প্রত্যুষ পর্যন্ত বিরাজিত থাকে সেই শান্তিময়তা। আবার বলেছেন, ‘হা-মীম। শপথ, সুস্পষ্ট গ্রন্থের। নিশ্চয়ই আমি এই গ্রন্থ প্রেরণ করেছি এক শুভ রজনীতে। আমি এক সতর্ককারী। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই রজনীতেই। আমার আদেশে আমি রাসুল প্রেরণ করে থাকি।’ অন্য এক স্থানে আবার বলেছেন, ‘...যদি তোমরা আল্লাহ্‌র ওপর বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো যা আমি মীমাংসার দিন আমার দাসের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম যখন দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।’ দুই দল মানে বদরযুদ্ধে রাসুলে করিম (সা.) ও পৌত্তলিকেরা। জাফর ইবনে আলী ইবনে হুসায়নের মতে, রাসুলুল্লাহ্‌র (সা.) পৌত্তলিকদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিনটি ছিল ১৭ রমজান, শুক্রবার।

তারপর রাসুলে করিম (সা.) যখন আল্লাহ্‌তে এবং তাঁর প্রেরিত ওহিতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করছিলেন, তখনই ওহি আসা শুরু হলো পুরোদমে। তিনি কায়মনোবাক্যে তা গ্রহণ করতে শুরু করলেন। তা সে মানুষের প্রতি শুভকামনাই হোক আর ভীতি প্রদর্শনই হোক, ঐশী বাণী বড় কঠিন বস্ত্ত। আল্লাহ্‌র কৃপায় কেবল শক্ত-সমর্থ ও দৃঢ়চেতা মাধ্যমই তা বহন করতে সক্ষম হয়। কারণ, আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারে বিরোধিতা বড় প্রবল প্রকৃতির হয়। রাসুলুল্লাহ্‌ (সা.) আল্লাহ্‌র নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করেছেন, বৈরিতা বা নির্যাতন কোনো কিছুতে পশ্চাৎপদ হননি।

খুয়ায়লিদের মেয়ে খাদিজার ইসলাম গ্রহণ

খাদিজা তাঁকে বিশ্বাস করলেন। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যা তিনি বহন করে আনলেন, সবকিছু সত্য বলে গ্রহণ করলেন। তাঁকে তিনি সাহাঘ্য করলেন। তিনিই প্রথম বিশ্বাস করলেন আল্লাহ্‌র ওপর, তাঁর রাসুলের ওপর বিশ্বাস করলেন আল্লাহ্‌র বাণীর সত্যতাকে। তাঁকে দিয়ে আল্লাহ্‌ তাঁর বোঝা লাঘব করে দিতেন। বিরোধিতা কিংবা মিথ্যাচারের অভিযোগ তিনি শুনে যেতে লাগলেন। তাতে তিনি ব্যথিত হতেন, কিন্তু ঘরে প্রত্যাবর্তন করলেই তিনি শান্তি পেতেন, আল্লাহ্‌ খাদিজার মাধ্যমে তাঁকে আশ্বস্ত করতেন। তিনি তাঁকে সাহস জোগাতেন। তাঁর বোঝা লাঘব করতেন, তাঁর সত্যকে সমর্থন করতেন, বিরোধীদের সমস্ত নিন্দাকে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতেন। আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান, তাঁর মঙ্গল করুন।

রাসুলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ্‌ আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি যেন খাদিজাকে জান্নাতের একটি সুরম্য গৃহের সন্ধান জানিয়ে দিই, যে গৃহে কোনো অশান্তি নেই, কোনো পরিশ্রম নেই।’ এ কথা বলেছেন হিশাম ইবনে উরওয়া। তিনি সে কথা শুনেছেন তাঁর বাবা উরওয়া ইবনে আল-জুবায়েরের কাছ থেকে, উরওয়া পেয়েছেন আবদুল্লাহ্‌ ইবনে জাফর ইবনে আবু তালিবের কাছ থেকে।

তারপর একসময় ওহি নাজিল হঠাৎ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। রাসুলে করিম (সা.) তাতে খুব দমে গেলেন, দুঃখ পেলেন। তারপর জিবরাইল তাঁর কাছে নিয়ে এলেন প্রভাতের সুরা। তাতে আল্লাহ্‌ জানালেন তিনি তাঁর সম্মানের পাত্র, শপথ করে বললেন, তাঁকে তিনি পরিত্যাগ করেননি, তাঁকে তিনি অসম্মান করেন না। আল্লাহ্‌ বললেন, ‘নিস্তব্ধ প্রভাত এবং রজনীর শপথ, তোমাকে তোমার প্রতিপালক পরিত্যাগ করেননি, তোমার প্রতি বিরূপও হননি তিনি। তার অর্থ তিনি তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, সম্পর্ক ছিন্ন করেননি, এত ভালোবাসার পর তোমার প্রতি বিরূপ হননি। আরও বলেছেন, ‘তোমার জন্য পরকাল ইহকালের চেয়ে শ্রেয়।’ তার অর্থ, ‘এখন এই পৃথিবীতে তোমাকে যে সম্মান দিচ্ছি, তার চেয়ে অনেক অনেক অধিক মর্যাদা তুমি পাবে, যখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। এবং তিনি তোমাকে অনুগ্রহ দান করবেন এবং তোমার সন্তুষ্টি বিধান করবেন’—অর্থাৎ ইহকালে দেবেন বিজয় আর পরকালে পুরস্কার। ‘তিনি কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পাননি এবং তোমাকে আশ্রয়দান করেননি? এবং তোমাকে পথহারা পেয়ে পথনির্দেশ করেননি? এবং নিঃস্ব অবস্থায় পেয়ে অভাবমুক্ত করেননি?’ এমনি করে আল্লাহ্‌ বলেছেন কেমন করে তিনি তাঁর ওপর এই জগতে করুণা বর্ষণ করেছেন, এক এতিম ও পথহারা বালক হিসেবে তাঁর প্রতি দয়া প্রদর্শন করেছেন, পরম মমতায় সমস্ত আপদ থেকে তাঁকে মুক্ত রেখেছেন।

সুতরাং, তুমি এতিমের প্রতি নির্দয় হয়ো না। সাহায্যপ্রার্থীকে কটু কথা বলো না। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র দুর্বলতম বান্দাদের জন্য তুমি কঠোর হতে পারবে না, অহংকারী, রুক্ষ অথবা কুটিল হতে পারবে না।

‘তুমি তোমার প্রভুর অনুগ্রহের কথা সবাইকে জানিয়ে দাও।’ এর অর্থ আল্লাহ্‌ পরম অনুগ্রহ করে তোমাকে নবুয়ত দিয়েছেন, এ কথা সবাইকে জানিয়ে দাও, তা প্রচার করো।

অতএব, আল্লাহ্‌র এই করুণার কথা তিনি গোপনে বলতে লাগলেন, যাদের তিনি বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন, তাদের কাছে তাঁর নবুয়তের কথা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন।

অনুবাদ: শহীদ আখন্দ

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে