আল্লাহ–তাআলা পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠানোর চিন্তা থেকে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন। আদম হিব্রু শব্দ, অর্থ মানুষ। তিনি সৃষ্টির প্রথম মানব। আদম (আ.)–এর বসবাস ছিল জান্নাতে। যেখানে অশান্তি নেই, অভাব-অনটন নেই, দুশ্চিন্তা নেই। চারপাশে আছে অগণিত নেয়ামত। নানান স্বাদের খাবার ও ফল। হরেক রঙের ফুল। চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায়। হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে আসে কাঙ্ক্ষিত সবকিছু। কিন্তু এত কিছুর ভিড়ে তাঁকে ছুঁয়ে যায় এক শূন্যতা। তাঁর কোনো সঙ্গী ছিল না। স্ত্রী ছিল না—যার কাছে তিনি প্রশান্তি পেতে পারেন। যার সঙ্গে জান্নাতের উদ্যানে বসে গল্প করতে পারেন। নিজেকে বড় একলা লাগে। পীড়িত লাগে।
একদিন হজরত আদম (আ.) ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, তাঁর মাথার কাছে একজন নারী বসে আছেন। তাঁর মতোই অবয়ব, সৃষ্টির উপাদান এক। কথাবার্তা বলে জানতে পারলেন, এ নারীকে তাঁর একাকিত্ব ঘুচাতে ও প্রশান্তির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা পরস্পরে স্বামী-স্ত্রীর পরিণয়ে (বিবাহবন্ধনে) আবদ্ধ হলেন। মহানন্দে জান্নাতে থাকতে লাগলেন। সুখেই দিন কাটছিল তাঁদের। আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে বললেন, ‘তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে থাকো। যা ইচ্ছা খাও। (এরপর বিশেষ একটি গাছ দেখিয়ে আল্লাহ–তাআলা বললেন) তোমরা এর কাছেও যাবে না। অন্যথায় জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৫)
গাছের ধারেকাছে যেতে নিষেধ করে আল্লাহ তাঁদের পরীক্ষা নিলেন। এদিকে ইবলিস তাঁদের ধোঁকায় ফেলতে নিরন্তর চেষ্টা করছিল। ইবলিস ছিল আদমের প্রতি অখুশি। তাঁর কারণেই সে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত পড়েছে। সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, যেহেতু আপনি আমাকে ভ্রান্তপথে ঠেলে দিলেন, কাজেই আমিও পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপকাজকে সুশোভিত করে দেখাব আর তাদের সবাইকে বিভ্রান্ত করব।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৩৯)
ইবলিস আদম ও হাওয়া (আ.)–কে কুমন্ত্রণা দিতে লাগল। শয়তানের কুমন্ত্রণার ফাঁদে পড়ে তাঁরা নিষিদ্ধ গাছের ফল খেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শরীর থেকে জান্নাতের পোশাক খুলে গেল। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে শরীর ঢাকলেন। আল্লাহ তাঁদের জান্নাত থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। আদম (আ.) বেশ অনুতপ্ত হলেন। খুব দুঃখ পেলেন। কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। আল্লাহর দয়া হলো। তিনি একটি বিশেষ দোয়া শিখিয়ে দেন, বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা জালামনা, আংফুসানা ওয়াইন-লাম তাগফির লানা, ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন। অর্থাৎ, ‘হে আমাদের রব, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন, আমাদের দয়া না করেন, তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৩)
আল্লাহর শেখানো দোয়াটি পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। আল্লাহ ক্ষমা করলেন। তওবা ও ইবাদতে তিনি খুশি হলেন। আদম-হাওয়াকে পুনর্মিলন করলেন। জান্নাতে আদম (আ.) তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হননি। পৃথিবীতে আসার পর জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে এর নির্দেশ নিয়ে আসেন এবং পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১/১৯৮)
তাঁদের প্রতিটি মিলনে প্রতিবার এক জোড়া করে সন্তান জন্ম নিত। একটি পুত্র ও একটি কন্যা। এই পুত্র-কন্যাদের মধ্যে বিয়ে হয়। এভাবে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নারী-পুরুষ ছড়িয়ে দেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
আদম ও হাওয়া (আ.) দম্পতির কতজন সন্তান ছিল, এ ব্যাপারে কোরআন-হাদিসে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধর্মতাত্ত্বিকদের থেকে দুটি মতামত পাওয়া যায়। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারির (রহ.) বলেন, ‘হাওয়া (আ.) ২০ বার গর্ভধারণ করে ৪০টি সন্তান প্রসব করেছিলেন। প্রতিবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত।’ (নবুওয়াতু আদম ওয়া রিসালাতুহু, পৃ ১১৫)।
অনেকে আবার বলেন, ‘হাওয়া (আ.) ১২০ বার গর্ভধারণ করেন। প্রতিবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে প্রসব করেন।’ আদম (আ.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর সন্তান ও পরিবারের সদস্যসংখ্যা চার লাখে উন্নীত হয় বলে তাঁরা দাবি করেন। (মুজাজুত-তারিখিল ইসলামি, খণ্ড ২, পৃ ১৩)
আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) দম্পতির বহু সন্তান থাকলেও কোরআন-হাদিসে শুধু তিনজনের নাম পাওয়া যায়—হাবিল, কাবিল ও শিস (আ.)। (সুরা মায়িদা, আয়াত, ২৭; কানজুদ্দুরার ওয়া জামিউল গুরার, খণ্ড ২, পৃ ৬৪)
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম