ঘটনাটি ইসলামের সোনালি সময়ের। ইরাকের একজন বিখ্যাত বিচারক ছিলেন কাজি আবু বকর আল বাকিল্লানি (রহ.)। কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল।
একবার একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁকে পশ্চিমের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে নিমন্ত্রণ করা হলো। বিতর্কের বিষয় ইসলাম বনাম খ্রিষ্টধর্ম। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।
বাইজান্টাইন রাজপ্রাসাদে চলছিল বিশাল আয়োজন। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি হলো, রাজাদের উপস্থিতিতে সবাইকে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাতে হয়। তারা জানত আবু বকর আল বাকিল্লানি রাজার সামনে মাথা নিচু করবেন না, মুসলিমরা শুধু আল্লাহর সামনেই মাথা নত করে। বাইজান্টাইনরা চালাকি করে মঞ্চে ঢোকার পথে একটি দরজা তৈরি করল। এমনভাবে এটি তৈরি করা হলো যেন দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়।
আবু বকর আল বাকিল্লানি (রহ.) প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। মঞ্চে ওঠার সময় দরজা দেখে তিনি তাদের চালাকি ধরে ফেললেন। তিনি দরজা দিয়ে প্রবেশের সময় পেছনে ফিরে নিচু হলেন, অর্থাৎ রাজার দিকে পিঠ দিয়ে ঢুকলেন। চালাকি কাজে আসেনি দেখে রাজা খুবই ইতস্তত বোধ করতে লাগলেন। তিনি বুঝে ফেললেন, এই লোককে বিতর্কে হারানো সহজ হবে না।
এরপর আবু বকর আল বাকিল্লানিকে সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা দেওয়া হলো। তিনি ইউরোপের স্থানীয় পুরোহিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
হঠাৎ প্রাসাদের দেয়াল আলোকিত হয়ে উঠল। একদল পাদরি রাজকীয় পোশাকে মোমবাতি ও বাইবেল হাতে প্রবেশ করলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন খুবই জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরা একজন ব্যক্তি। তিনি হলেন প্রধান ধর্মযাজক। হতে পারে, তিনি সেই সময়ের পোপ। তাঁর সঙ্গে আজ বিতর্ক করবেন আবু বকর আল বাকিল্লানি (রহ.)।
ধর্মযাজকের রাজকীয় পোশাকের দিকে দৃষ্টি দিলেন না আবু বকর আল বাকিল্লানি। তিনি কুশল বিনিময় করে বললেন, ‘আপনার স্ত্রী–সন্তানেরা কেমন আছেন, জনাব?’
এ কথা শুনে প্রধান ধর্মযাজক চোখ বড় করে তাঁর দিকে তাকালেন। দর্শকেরাও তাকিয়ে রইল রাগের দৃষ্টিতে। তারা বলতে লাগল, ‘এটা তো অনেক বড় অপমান। কীভাবে সে আমাদের ধর্মযাজককে এসব জিজ্ঞাসা করে। সে কি জানে না, স্ত্রী-পুত্রের মতো সামান্য বিষয় ধর্মযাজক গ্রহণ করেন না।’
আবু বকর আল বাকিল্লানি (রহ.) জানতেন, খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা স্ত্রী-পুত্র গ্রহণ করেন না। তিনি কথাগুলো ইচ্ছা করে বলেছেন। তিনি মধুর সুরে সুরা মরিয়ম তিলাওয়াত করতে লাগলেন, ‘তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা খুবই অদ্ভুত কথা বলেছ। এ কথার প্রভাবে নভোমণ্ডল ফেটে যেতে চায়, পৃথিবী ও পর্বতমালা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে চায়। কারণ, তারা বলে দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। অথচ সন্তান গ্রহণ করা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়।’ (সুরা মরিয়ম, আয়াত: ৮৮–৯২)
আবু বকর আল বাকিল্লানি দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের ধর্মযাজকের স্ত্রী-পুত্র থাকা যদি অসম্মানজনক হয়, তাহলে একবার ভাবুন তো, যখন কেউ বলে সৃষ্টিকর্তার সন্তান হয়েছে, সেটা কতটা অসম্মানের।’
বিতর্ক চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। বিতর্কের একপর্যায়ে একজন বলে উঠল, ‘আপনাদের নবীর ওই স্ত্রী সম্পর্কে কী বলবেন যিনি খারাপ কাজ করে ধরা পড়েছিলেন?’
সে হজরত আয়েশা (রা.)–এর কথা বলছিল। আয়েশা (রা.)–কে নিয়ে আরবের একদল মুনাফেক খারাপ কথা ছড়াচ্ছিল। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল করে তাঁর চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করেছিলেন।
আবু বকর আল বাকিল্লানি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষায় ফেলেন। তিনিই আবার আয়েশা (রা.)–এর সম্মান রক্ষা করেছেন। একইভাবে আল্লাহ তাআলা হজরত মরিয়ম (আ.)–এর সম্মানও রক্ষা করেছিলেন, যখন মানুষ তাঁকে অপবাদ দিচ্ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মান বৃদ্ধি করে তাঁকে সব নারীর ওপরে স্থান দিয়েছেন।’
এ কথার পর আর কিছু বলার থাকে না। বাইজান্টাইনের রাজা দ্রুত অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তিনি আবু বকর আল বাকিল্লানি (র.)–কে বিদায় করেছিলেন।
আবু বকর আল বাকিল্লানি (র.) স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে ইরাকে ফিরে এলেন এবং সবকিছু বায়তুল মালে দান করে দিলেন।
অনুবাদ: সাজিদ আল মাহমুদ