খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর আগের কথা। তৎকালীন মাদায়েন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের উর্বর জায়গা। এর অধিবাসীরা ব্যবসায় বেশ সমৃদ্ধি এনেছিল। কিন্তু তারা ব্যবসায় জালিয়াতি করত। ওজনে কম দিত। মানুষের হক নষ্ট করত। ডাকাতি ও রাহাজানি চালাত। আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার নির্ধারণসহ নানা পাপাচারে লিপ্ত ছিল তারা। আল্লাহ তাদের কাছে হেদায়াতের আলো দিয়ে শোয়াইব (আ.)-কে পাঠালেন। তিনি তাদের একাত্ববাদের দাওয়াত দিলেন। পাপ ছাড়তে বললেন। তারা তাঁর কথা শুনল না; বরং বড়াই করল। ফলে আল্লাহর আজাবে তারা ধ্বংস হলো।
মাদায়েন শহরের অবস্থান ছিল আরবের উপদ্বীপে। পরে মাদায়েনবাসী কওমে শোয়াইব বা শোয়াইবের জাতি নামে পরিচিতি পায়। ইতিহাসে তারা কওমে শোয়াইব নামেই পরিচিত। বর্তমান সিরিয়ার মুয়ান বা মায়ান নামক স্থানে কওমে শোয়াইবের বসবাস ছিল বলে ধারণা করা হয়। ইতিহাসবিদেরা বলেন, শোয়াইব (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র মাদায়িনের বংশধর। কেউ কেউ বলেন, শোয়াইব (আ.) ছিলেন হজরত সালেহ (আ.)-এর বংশধর। (তাফসিরে কোরআনুল আজিম, ইমাদুদ্দিন বিন কাসির, খণ্ড ৭, পৃ ২৪৮)
শোয়াইব (আ.)-এর দুই মেয়ে চারণভূমিতে পশু চরাতেন। বাড়ি ফেরার আগে কুয়া থেকে পশুগুলোকে পানি খাওয়াতেন। প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে বেলা হয়ে আসত তাঁদের। একদিন বেশ আগে ফিরলেন তাঁরা। বাবা রীতিমতো বিস্মিত। জানলেন, এক অপরিচিত যুবক পানি তুলতে তাদের সাহায্য করেছেন। যুবককে বাড়ি নিয়ে যেতে এক মেয়েকে পাঠালেন। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহীউদ্দীন খান, পৃ ১,০১০)
যুবক দাওয়াত কবুল করে পথ চললেন। বালিকার কাছ থেকে পথ চিনে নিয়ে তাঁকে পেছনে চলতে বললেন। বালিকার প্রতি দৃষ্টিপাত এড়াতে এ কৌশল নিয়েছিলেন তিনি। পরে এ ব্যাপার নিয়ে পিতার কাছে প্রশংসা করেছিলেন বালিকা। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহীউদ্দীন খান, পৃ ১,০১০)
যুবক বাড়ি এলেন। আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। পানাহার শেষে শোয়াইব (আ.) যে প্রস্তাব দিলেন, তার জন্য যুবক একবারেই অপ্রস্তুত ছিলেন। সেই ঘটনা কোরআনে বর্ণনা হয়েছে এভাবে, ‘স্ত্রীলোক দুটির একজন বলল, হে পিতা, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাকে নিযুক্ত করুন, আপনি যাদের মজুর নিযুক্ত করবেন, তাদের মধ্যে উত্তম যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত। আমার এ দুই মেয়ের একজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই। এ শর্তে যে তোমাকে আমার এখানে আট বছর চাকরি করতে হবে। আর যদি ১০ বছর পূর্ণ করো, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা।...মুসা (আ.) জবাবে বললেন, আমার ও আপনার মধ্যে এ কথা ঠিক হয়ে গেল…।’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ২৬-২৮)
যুবক ছিলেন বনি ইসরায়েল জাতির প্রতি প্রেরিত আল্লাহর বিশেষ নবী মুসা (আ.)। মুসা জন্মেছেন মিসরে। তখন মিসরের ফেরাউন বা বাদশাহ ছিল কাবুস। দ্বিতীয় রামেসিস হিসেবে লোকে জানে তাকে। মুসা ছিলেন ইসরায়েলি। সে সময় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ফেরাউন বনি ইসরায়েলের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত। এর মধ্যে মুসা (আ.)-এর জন্ম হয়। মা তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহর কুদরতে ফেরাউনের ঘরেই বিশেষ যত্নে বেড়ে উঠতে থাকেন মুসা।
মুসা তখন যুবক। বাজারে গেলেন কাজে। দেখলেন, দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছে। একজন ফেরাউনের অনুসারী কিবতি, অন্যজন ইসরায়েলি। মুসা মীমাংসা করে দিতে চাইলেন। কিন্তু কিবতি তার কথা শুনছিল না। সে বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে লাগল। মুসা রাগে কিবতির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লোকটি মারা পড়ল।
বিদ্যুৎ গতিতে মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ফেরাউনের রাজ্যে তার অনুসারীকে হত্যা! রাজ্য থেকে সিদ্ধান্ত এল, মুসাকেও হত্যা করা হোক। মুসাকে খোঁজা শুরু হলো। মুসার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বললেন, আপনি শহর ছেড়ে দেন। মাদায়েন চলে যান। সেখানে এক বুজুর্গ ও সৎ ব্যক্তি আছেন, তার সংস্রবে থাকতে পারবেন। (কাসাসুল কোরআন, খণ্ড ৪, পৃ ১৫)
মুসা (আ.) দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মাদায়েন শহরে পৌঁছালেন। পানি পান করতে একটি কূপের কাছে গেলেন। কূপে তখন মানুষের জটলা। শক্তিশালীরা আগেভাগে পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে নিচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে দুজন রমণী একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন পুরুষের ভিড় কমে যাওয়ার। মুসা (আ.) তাঁদের সঙ্গে যেচে কথা বললেন। তাঁদের বাবা বৃদ্ধ হওয়ায় তাঁরা পশুকে পানি পান করাতে নিয়ে এসেছেন। মুসা তাঁদের সাহায্য করলেন। কূপ থেকে পানি তুলে দিলেন। তাঁরা খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন। পরে মুসারও বেহাত হলো তাঁদের বাড়ি ফেরার।
মুসা (আ.) শোয়াইব (আ.)-এর দেওয়া শর্ত পূরণ করেছিলেন। বিয়ে করেছিলেন শোয়াইব (আ.)-এর ছোট মেয়েকে। শ্বশুরের পক্ষ থেকে উপহার পেয়েছিলেন একটি লাঠি। যেটা তাঁর বহু কাজে দিয়েছিল।
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম