খাদিজা (রা.)–এর ব্যবসা পরিচালনার ৫টি রীতি

সাইয়িদা খাদিজা (রা.) একজন সম্ভ্রান্ত ও সম্পদশালী নারী ছিলেন। পিতা ও স্বামীর থেকে পাওয়া সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য নানামুখী ব্যবসা পরিচালনা নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে দিন দিন ব্যবসায়িক সাফল্যের উচ্চ আসনে আসীন হতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বর্তমান সময়েও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে সাইয়িদা খাদিজার (রা.) গৃহীত নীতি ও কৌশলগুলো অনুসৃত হয়। তাতে সফলতাও মেলে। ইতিহাসের আলোকে তাঁর কিছু ব্যবসায়িক নীতি ও কৌশলের বিবরণ তুলে ধরা হলো।

১. মুদারাবা চুক্তিতে ব্যবসা পরিচালনা

সাইয়িদা খাদিজা (রা.) ইসলামি অর্থনীতির প্রসিদ্ধতম পদ্ধতি মুদারাবা চুক্তির ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। নারী হওয়ায় সংগত কারণে তিনি ব্যবসা পরিচালনার কাজে দূর দেশে সফর করতে পারতেন না। এ সমস্যার সমাধানে তিনি মুদারাবা ব্যবসা নীতিগ্রহণ করেছিলেন। তার বিনিয়োগে কর্মীরা শ্রম দিয়ে অংশীদার হয়ে ব্যবসার লভ্যাংশ গ্রহণ করত। (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা, ড. ইয়াসির ক্বাদি, অনুবাদ: মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, প্রচ্ছদ প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ২৫) মূলত তিনি ছিলেন একজন বিনিয়োগকারী। পুরুষ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১০০; সিরাতুন নববিয়্যাহ, সাল্লাবী, পৃষ্ঠা: ৭০)

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামি অর্থনীতির মুদারাবা নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালিত হয়। বিশেষত বিভিন্ন দেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে এ নীতি ও পদ্ধতি ব্যাপকভাবে অনুসৃত। একশ্রেণির মানুষ অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং আরেক শ্রেণির মানুষ শ্রম ও মেধা খাটিয়ে ব্যবসার উন্নতি ঘটান। এতে দুই পক্ষই লাভবান হন। বিশ্ব অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা ঋণ, অর্থায়ন ও বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোর অধিকাংশের নীতি এমনটাই—এক পক্ষের অন্য পক্ষকে বিনিয়োগের সুবিধা দেয়, তাতে উভয় পক্ষই লাভবান হয়। তবে এক্ষেত্রে সবাই সৎ বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগ গ্রহীতা নির্বাচনে সতর্ক থাকেন।

মার্কিন ব্যবসায়ী ওয়ার্ল্ড ডিজনির সাবেক চেয়ারম্যান ও সিইও মাইকেল আইনসনার বলেছেন, ‘নিঃস্বার্থ একজন ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজে পাওয়া বিরল। আপনি যদি ভাগ্যবান হন, তবে আপনার জীবনে তা একবারই ঘটবে।’ (চাকরি ছেড়ে ব্যবসা, মুবির চৌধুরী, স্বরে অ, পৃষ্ঠা: ৮৩)

২. লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবস্থাপক

ব্যবসায়িক মুনাফার অংশ প্রদানের চুক্তিতে ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন সাইয়িদা খাদিজা (রা.)। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি লভ্যাংশও দিতেন। ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে লোকবল বা ব্যবস্থাপক বা পরিচালক নিয়োগ করাটা ছিল তাঁর ব্যবসায়িক কৌশল। (সিরাতুন নববিয়্যাহ, ইবনে ইসহাক, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৭০)

বর্তমান বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানিতে লভ্যাংশ প্রদানের ভিত্তিতে বা চুক্তিতে ব্যবস্থাপক নিয়োগের উদাহরণ বা প্রথা পরিলক্ষিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতে কোম্পানির মালিক এবং কর্মী-উভয় পক্ষই সুবিধাপ্রাপ্ত হন। ব্যবসাবাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু ব্যবস্থাপক বা বড় কর্মকর্তাদেরই নয় প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীকে লভ্যাংশ প্রদানের আওতায় আনা সম্ভব হলে, তা প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধির পথ খুলে দেবে। কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই সে প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্রানসন বলেছেন, ‘গ্রাহকরা প্রথমে আসে না। কর্মীরা প্রথমে আসে। আপনি যদি আপনার কর্মীদের যত্ন নেন; তাহলে তারা গ্রাহকের যত্ন নেবে।’ (চাকরি ছেড়ে ব্যবসা, মুবির চৌধুরী, স্বরে অ, পৃষ্ঠা: ১৮৮)

৩. ব্যবস্থাপকের ভালো-মন্দ যাচাই

নারী হওয়ার কারণে খাদিজা (রা.) বিদেশে বা অন্য শহরে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিয়মিত সফর করতে পারতেন না বলে ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে এ সমস্ত কাজ করাতেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপকের গতিবিধি এবং তার বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের জন্য কাফেলার সঙ্গে তার নিজস্ব বিশ্বস্ত প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন। ব্যবস্থাপকের ভালো-মন্দ যাচাই করার জন্য এটা ছিল তার স্বতন্ত্র একটি ব্যবসায়িক কৌশল।

সাইয়িদা খাদিজার ব্যবসায়িক প্রস্তাবে রাজি হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন সফরে যাচ্ছিলেন তখন খাদিজা তাঁর ভৃত্য মাইসারাকে তার সহযোগী হিসেবে সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফি সিরাতি খাইরিল ইবাদ, মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ শামি, ০২/২১৯)

অনেক দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি পরিচালনাকারী ব্যবস্থাপক বা পরিচালকের কাজ যাচাইবাছাই বা পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা পরামর্শক বা বিশ্লেষক রাখা হয়। একটি সফল প্রতিষ্ঠান গড়ার নেপথ্যে এমন পর্যবেক্ষক রাখার বিষয়টিকে বর্তমান সময়ের বিশেষজ্ঞরা জরুরি মনে করেন। এ ছাড়া বর্তমানে এমন অনেক তৃতীয় পক্ষ কোম্পানিও রয়েছে, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে কর্মীসহ সার্বিক কাজের মনিটরিং, অডিটিং ও মূল্যায়ন তদারিক করে।

৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা

মাইসারাকে সাইয়িদা খাদিজা সফরের শুরুতে বলেছিলেন, ‘তুমি তাঁর (মুহাম্মাদ) কোনো নির্দেশ অমান্য করবে না; কোনো সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করবে না।’ (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা: ২১৯)

ব্যবসায়িক সফরের সূচনাক্ষণে মাইসারাকে লক্ষ করে খাদিজা (রা,) এই কথায় তার ব্যবসায়িক কর্মকৌশলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে উঠেছে। এ নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি ব্যবস্থাপক বা ব্যবসার জন্য নিয়োগকৃত প্রতিনিধি হিসেবে রাসুলুল্লাহকে (সা.) ব্যবসা পরিচালনার স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস প্রদান করেছেন।

প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি পরিচালনাকারী ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন দক্ষ ব্যবস্থাপককে স্বাধীনতা দেওয়া হলে ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ঘটে।

শুধু ব্যবস্থাপক বা পরিচালক নয়; বিশ্বের সফল সব ব্যবসায়ী এখন প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীকে স্বাধীনতা দেওয়ার সুফলের কথা জানাচ্ছেন। ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সিইও রিচার্ড ব্রানসন ‘আপনার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাধীনতা দিন’ শিরোনামে একটি লেখায় বলেছেন, সিইও আর ব্যবস্থাপকদের ব্যবসা পরিচালনা করার স্বাধীনতা দেওয়ার কারণে ভার্জিন গ্রুপ আজ কয়েক ডজন কোম্পানির নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়েছে। যদিও এ দর্শন ব্যবসার স্বাভাবিক নিয়মের উল্টো এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো—এ দর্শনটি ভার্জিন গ্রুপের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।’

৫. পরামর্শকের সহায়তা নেওয়া

সাইয়িদা খাদিজা (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফালকে পরামর্শক হিসেবে মানতেন। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতেন। খাদিজার ব্যবসায়িক সফলতা, ব্যক্তিগত উন্নত জীবন গঠন এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাজগৎ নির্মাণের নেপথ্যে ওয়ারাকা ইবনে নাওফালের পরামর্শের অনেক প্রভাব-অবদান দেখা যায়। সাইয়িদা খাদিজার বাণিজ্যিক অভূতপূর্ব সফলতায় পরামর্শক মেনে চলা এবং মক্কার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অনেক প্রভাব ছিল। (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.), শাইখ আব্দুল হামিদ মাহমুদ তাহমাজ ও শাইখ ইবরাহিম মুহাম্মাদ হাসান আল জামাল, অনুবাদ: মাহমুদ সিদ্দিকী, দ্বীন পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা: ৫০)

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সফল করার জন্য অভিজ্ঞ পরামর্শক রাখাকে বর্তমান বিশ্বের ব্যবসানীতিতে আবশ্যক মনে করা হয়। ‘হোয়াই শুড কম্প্যানিজ হায়ার আ বিজনেস কনসালট্যান্ট’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে সার্ভেয়াজিস স্ট্র্যাটেজিক কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া ইয়াদওয়াদকার পরামর্শক নিয়োগের পক্ষে অনেক যুক্তি দেওয়ার পর লিখেছেন, ‘পরামর্শক আপনার প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায় একটি শক্তি ও গতি আনতে সহযোগিতা করবে এবং কৌশলগত নানামুখী সমাধান সরবরাহ করবে। সুতরাং আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতার স্তরে উন্নতি ঘটাতে চান, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো মজবুত রাখতে চান, জটিল সব সমস্যার অভিজ্ঞতালব্ধ সমাধান খুঁজতে চান, তাহলে ব্যবসায়িক পরামর্শক রাখুন।’

 মিরাজ রহমান: লেখক