মক্কায় কাবা শরিফ।
মক্কায় কাবা শরিফ।

হজ সফর ১৭

মক্কায় গিয়ে ফরজ তাওয়াফ

১০ জিলহজের দিন বড় জামারায় রমি করা বা কঙ্কর নিক্ষেপের পর হাদী জবাই করা বা দমে শোকর আদায় করতে হয়। আমরা যারা আগেই কুপন কিনেছি, তারা কেউ কেউ বিকেল বা সন্ধ্যায় চুল কেটে প্রাথমিক হালাল হয়েছি। ধরে নেওয়া গেছে যে ততক্ষণে দমে শোকর আদায় হয়ে গেছে। তবে দমে শোকর আদায় না হওয়ার আগে চুল কাটা যাবে না, এমন কঠোর বিধিনিষেধও নেই।

তো, হোটেলে ফিরে হাত-পা ধুয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কয়েক মুহূর্ত পরে ঢলে পড়লাম ঘুমের কোলে। ঘুম ভাঙল আমার সহধর্মিণীর ডাকে। উঠে দেখি আসরের ওয়াক্ত বুঝি ছুটে যায়। দ্রুত অজু করে নামাজ পরে নিচে নেমে এলাম। কাছেই একটা দোকান থেকে মাথা কামিয়ে নিলাম। তারপর মাগরিবের নামাজ আদায় করে রুমে এসে ইহরামের লেবাস ছেড়ে গোসল করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়লাম। তারপর আবার নিচে গেলাম চা খেতে। দুজনের ফোনেও টাকা ভরলাম। আরাফার দিন ফোনে টাকা না থাকায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে সমস্যা হয়েছিল।

ইশার আজানের পর হোটেলের এম ফ্লোরে জামাতে নামাজ আদায় করলাম। বেশির ভাগ হাজি মিনায় রয়ে গেছেন। অনেকেই রাতে মক্কায় আসবেন ফরজ তাওয়াফ করতে। তানজীর ওর মা ও সহধর্মিণীকে নিয়ে জামারায় রমি করে দুপুরের আগেই হোটেলে চলে এসেছিলেন। আমাদের দলের নজরুল ভাই, সানোয়ার ও সামী সকালে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করে পায়ে দল করে মক্কায় এসে হারামে ফরজ তাওয়াফ ও সায়ী সেরে ফেলেছেন। তারপর রুমে এসে ঘুমিয়েছেন। সাব্বির ভাই, ইকবাল ও মাশরুর একইভাবে হজের সব ফরজ আদায় করে ফেলেছেন। আবার রোকন ওর মা ও শ্বশুরকে নিয়ে মিনা থেকে সন্ধ্যার পরে এসেছেন।

মাঝরাতে উঠে আমরা রওনা দিলাম হারামের উদ্দেশে। হারামে প্রবেশ করে তাওয়াফে ইফাদা বা ফরজ তাওয়াফ করতে করতে ফজরের আজান দিয়ে দিল। যখন শেষ চক্র পূরণ করতে হাতীম অতিক্রম করছি, তখন দেখি কাবার কয়েকজন খাদেম পরস্পর হাত ধরাধরি করে পথ আটকে দিতে দিতে বলছে, ‘তাওয়াফ ক্লোজ।’ আমি একপাশে ওদের হাত গলে বেড়িয়ে এলাম। আমার সহধর্মিণী আরেক পাশ দিয়ে। ফলে আমরা নামাজ শুরু হওয়ার আগেই ফরজ তাওয়াফ শেষ করে ভেতর দিকে গেলাম জমজমের পানি পান করতে। তারপর ওখানেই ফজরের সালাত আদায় করলাম।

তাওয়াফে ইফাদা বা তাওয়াফে জিয়ারত হলো হজের তৃতীয় ও শেষ ফরজ। এটি বাদ পড়লে হজ বাতিল হয়ে যায়। দম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করার সুযোগ নেই।

এরপর সায়ী করার পালা। ইমাম আবু হানিফা মতে এটি ওয়াজিব, বাকি তিন ইমামের মতে তাওয়াফের মতো ফরজ। সায়ী করতে গিয়ে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হলো। শক্তিশালী এসিগুলো যেন বেশি করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। সায়ী শেষ করে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। একটু পরে তানজীরাও এল। আমরা বেশ খানিকটা হেঁটে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম মিনায় মসজিদে খায়েফে যাওয়ার উদ্দেশে। চালক অবশ্য বলল, অতখানি পথ যাওয়া যাবে না। যেখানে পুলিশ আটকে দেবে, সেখানেই নামতে হবে—এই শর্তে গাড়িতে চাপলাম। বাদশা খালেদ রোডের সংযোগ স্থলে আমাদের নেমে যেতে হলো। ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে টানেল পেরিয়ে মিনা জরুরি হাসপাতালের পাশ দিয়ে গিয়ে খায়েফ মসজিদ। কিন্তু মসজিদে পুরুষদের অংশ একটু খালি থাকলেও মহিলাদের অংশে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বাইরে আর কোনো জায়গাও নেই। তবে অনেকে অজুখানার ভেতরে গিয়ে বসেছে। আমরা ওখানে ঢুকে আবার বেড়িয়ে আসলাম। ঠিক করলাম, জামারায় চলে যাব।

কয়েক মিনিট হাঁটতেই জামারা। এস্কেলেটর দিয়ে উঠে তৃতীয় তলায়। হাজিরা অল্প অল্প করে জড়ো হচ্ছেন। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ১০টাও বাজেনি। আইয়ামে তাশরিকের মানে জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার পর বা জোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর থেকে কঙ্কর মারার সময় শুরু। তবে কেউ কেউ আগেই বা সকাল সকাল কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। এ রকম কয়েকজনের মতো তানজীররা তিনজন অপেক্ষা না করে কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনায় চলে গেল। আমরা দুজন একপাশে অপেক্ষায় রইলাম বেশ কয়েকজন ভারতীয় ও পাকিস্তানি হাজির সঙ্গে। সৌদি পুলিশ অবশ্য দুবার করে সরিয়ে দক্ষিণদিকে বসতে দিল। এ সময় দেখলাম, বিমানবন্দরের ভেতরে যাত্রীদের দ্রুত স্থানান্তরের জন্য যে রকম ছয় বা আট আসনের ইলেকট্রিক গাড়ি চলে, সেরকম গাড়িতে করে কিছু হাজিকে জামারায় আনা হচ্ছে। পুব দিক থেকে উঠে আসা রাস্তা দিয়ে এসব গাড়ি বয়স্ক ও দুর্বল হাজিদের এনে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

ঘড়ি দেখে জোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর যখন অন্য হাজিরা কঙ্কর নিক্ষেপ শুরু করলেন, তখন আমরাও এগিয়ে গেলাম। প্রথমে ছোট জামারায়, তারপর মধ্য জামারায় আর সবশেষে বড় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করলাম। প্রতিটি জামারার একটি প্রান্তের কিছু অংশ হুইলচেয়ারে চেপে আসা হাজিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আবার জামারায় সুন্দর করে বড় হরফে আরবি ও ইংরেজিতে পরিচিতি লেখা আছে। ফলে কারও কোনো সমস্যা হয় না।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক