আরাফাত থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে মাগরিবের নামাজের সময় হলেও নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। সেখানে পৌঁছার পর মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে পড়েন হাজিরা।
আরাফাত থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে মাগরিবের নামাজের সময় হলেও নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। সেখানে পৌঁছার পর মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে পড়েন হাজিরা।

হজ সফর ১৫

মুজদালিফার মাটিতে ঘুম

মুজদালিফার দুই নম্বর স্টেশনে ট্রেন থামার পর আমরা নেমে পড়লাম দলে দলে। সেখানে মোয়াল্লেম কোম্পানির লোক ছিল প্ল্যাকার্ড নিয়ে। ওদের অনুসরণ করে স্টেশন থেকে আগের মতোই একাধিক র‌্যাম্প ও বেয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে হলো। নেমে দেখি পুরো জায়গাটায় হাজিরা অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন।

মুজদালিফার প্রান্তর সুবিশাল হলেও ট্রেন ব্যবহারকারী হাজিদের জন্য স্টেশনের নিচের কিছু অংশ বেড়া দিয়ে ঘিরে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আর এটা করতে গিয়েই সমস্যা দেখা দিয়েছে। যত সংখ্যক হাজি, তাতে এই জায়গায় আর কুলাচ্ছিল না। তার মধ্যেই আমরা কয়েকজন পাটি ও চাদর পেতে অবস্থান নিলাম। প্রায় সবারই গায়ে গায়ে লাগা অবস্থা। অথচ বেড়ার ওপারে অনেক খালি জায়গা পড়ে রয়েছে।

মুজদালিফায় এসে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে হয়। প্রথমে মাগরিবের সালাত। তারপরই আবার একামত দিয়ে ইশার সালাত। আমরা যে যেভাবে পারলাম সালাত আদায় করে নিলাম। যেহেতু স্থান সংকুলানে সমস্যা হচ্ছিল, তাই ঠিক পরিতৃপ্তি সহকারে সালাত আদায় হলো না। আল্লাহ কবুল করার মালিক।

আরাফাহ থেকে আসার সময় একটা থলেতে কয়েক বোতল পানি ও শুকনো খাবার ছিল। মুজদালিফায় এসে অবস্থান নেওয়ার একটু পরেই ওটা গায়েব। একই সঙ্গে আমার সহধর্মিণীর জুতাজোড়া। প্রচুর হাজির সমাগমে এবং একে অন্যের গা ডিঙিয়ে যাতায়াতের কারণে হয়তো বা ওগুলো কোথায় দূরে সরে গিয়েছিল। অথবা অন্য কোনো কিছু হয়েছিল। আর পাইনি। তবে, হজের সময় প্রায় প্রত্যেক হাজীই কোনো না কোনো অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। এটা সেরকম কিছু কি? নাকি আমাদের জন্য কোনো বার্তা? আল্লাহ ভালো জানেন।

এদিকে আমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছি সেখান থেকে টয়লেটেও বেশ দূরে। কয়েক হাজার হাজিকে ডিঙিয়ে ওখানে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমি খাবার পানি আনতে গিয়েও ফিরে এসেছি। গলা ভেজানোর ও অজু করার মতো পানিও আর সঙ্গে নেই।

আমাদের পাশাপাশি দুজন আরব নারী ছিল। শাহাদত ভাইর সহধর্মিণী উম্মে হাম্মাদ খুব ভালো আরবি পারেন। তিনি ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। জানা গেল যে ওরা মাঝরাতে উঠে চলে যাবে। বয়স্ক ও দুর্বল নারী-পুরুষসহ প্রয়োজনে মহিলাদের মাঝরাতে মুজদালিফা থেকে মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। ওরা চলে যাওয়ার পর ওই জায়গাটুকুতে আমি ও আমার সহধর্মিণী শুয়ে পড়লাম।

খোলা আকাশের নিচে মাটিতে এভাবে শুয়ে থাকাই মুজদালিফার বড় কাজ। সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। ওপরে খোলা আকাশে তারা জ্বলছে। আর মাটিতে আমরা লাখ লাখ হাজি শুয়ে আছি। সবারই এক নিয়ত, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। এভাবে শুয়ে ভেঙে ভেঙে ঘুমাচ্ছিলাম আমি। আবার অনেকে ভালোভাবেই ঘুমিয়ে নিতে পেরেছেন। এই ঘুমটাও মুজদালিফায় ইবাদতের অংশ।

সুবহ সাদিক হতে না হতেই আশপাশ থেকে মানুষজনের কথাবার্তার আওয়াজ বাড়তে লাগল। এখানে আমরা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার হাজিরা আছি। কেউ জামাতে আবার কেউ একাকী ফজরের সালাত আদায় করে নিলেন। কিন্তু অজু করব কীভাবে? শাহাদাত ভাই এক বোতল পানি দিলেন। ওটা দিয়েই সংক্ষেপে অজু সারলাম দুজন। তারপর ফজরের সালাত আদায় করলাম।

ফজরের সালাতের পর কঙ্কর সংগ্রহ শুরু করলাম। মুজদালিফার মাটিতে একটা নাড়াচাড়া করলেই কঙ্কর হাতে ঠেকে। একটা পানির বোতলে দুজনের জন্য প্রায় দেড় শ ছোট ছোট কঙ্কর নিলাম। বেশির ভাগের আয়তন বুটের দানার থেকে একটু বড়। বেশির ভাগ হাজিই মুজদালিফা থেকেই জামারয় নিক্ষেপের জন্য কঙ্কর সংগ্রহ করে নেন। তবে সবটুকু না পারলে প্রথম দিনে বড় জামারায় নিক্ষেপের জন্য হাজি প্রতি অন্তত সাতটি পাথর বা কঙ্কর নিতে হয়। বাকিগুলো পরে মিনা থেকেও সংগ্রহ করা যায়।

এদিকে জামারায় যাওয়ার জন্য হাজিরা রওনা হতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ অন্যকে তাড়া দিচ্ছেন। তবে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে পরে উপলব্ধি হয়েছে যে অত তাড়ার কিছু নেই। বিশেষত যাঁরা ট্রেনে যাবেন, তাঁদের একটু অপেক্ষা করে ভিড় কমলে যাওয়া উত্তম। একযোগে অনেকে রওনা দিতে গিয়ে সমস্যা হয়। সামনে থেকে পুলিশ পথ আটকে দিয়েছে, কিন্তু পেছন দিকের হাজিরা অতশত না বুঝে ঠেলাধাক্কা দিচ্ছেন। গরমে ও চাপাচাপিতে আমাদের তো শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার দশা। দুচারজন দেখলাম আর টিকতে না পেরে মাটিতে বসে পড়লেন বা অন্যদের গায়ে ঢলে পড়লেন। ভারতীয় এক মহিলা হাজির হাতে পানি ছিটানোর বোতল ছিল। আমি ‘বেহেনজী’ বলে অনুরোধ করে ওটা নিয়ে আমার সহধর্মিণী ও আমার মুখে পানি ছিটালাম। পাশে যিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, তারমুখেও ছিটিয়ে শুকরিয়া বলে ফেরত দিলাম।

পুলিশ বাধা সরিয়ে নেওয়ার পর হুড়মুড় করে স্টেশন প্রাঙ্গণে ঢুকে আমরা এক পাশে খালি জায়গায় গিয়ে বসলাম। আমার সহধর্মিণী বললেন যে ভিড় না কমলে আর এগোবেন না। আরও কয়েকজনকেও বসে থাকতে দেখলাম। তবে ততক্ষণে আমরা মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। আমি খাওয়ার পানি খুঁজলাম। পেলাম কিছু খালি বোতল। তিনটা খালি বোতলই নিয়ে নিলাম।

প্রায় আধা ঘণ্টার মতো বসেছিলাম। তবে পুলিশ আবার বসেও থাকতে দেয় না। তাড়া দিল যাওয়ার জন্য। সামনে এগিয়ে এক জায়গায় পানির কল পেলাম। কিন্তু পুলিশ ওদিকে যাওয়ার রাস্তা আটকে রেখেছে। আমার সহধর্মিণী পুলিশকে খালি বোতল দেখিয়ে বলল যে ’কারবালা’, ’কারবালা’। এবার পুলিশ পথ ছেড়ে দিল। ও দ্রুত দুটো বোতল ভরে পানি আনল। ভোরের দিকে একবার একটু গলা ভেজাতে পেরেছিলাম—সামী সামান্য একটু পানিসহ একটা বোতল দিয়েছিল। ওটা বাদ দিলে প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে দুজনে ঢক ঢক করে প্রাণভরে পানি পান করে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। মা হাজেরা যে শিশু ইসমাইলের পানির জন্য সাফা ও মারওয়ায় কতটা ব্যাকুল হয়ে ছোটাছুটি করেছিলেন, আল্লাহ হয়তো আমাদের তারই সামান্য একটু স্বাদ দিলেন মুজদালিফার রাতে। এই উপলব্ধিটা অবশ্য আমাদের পরে এসেছে, তাৎক্ষণিক আসেনি।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক