খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। তাঁর বাণিজ্য-সম্ভার যেত সিরিয়ায়। তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সবার পণ্যের সমান ছিল। হজরত খাদিজা (রা.) একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠানোর জন্য যোগ্য লোকের সন্ধান করছিলেন। সে কথা জেনে রাসুল (সা.)–এর চাচা আবু তালিব মুহাম্মদকে (সা.) ডেকে বললেন, সময়টা খুব সংকটজনক। আমরা মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছি। আমাদের কোনো ব্যবসা বা অন্য উপায়-উপকরণ নেই। একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যাচ্ছে। খাদিজা তাঁর পণ্যের সঙ্গে পাঠানোর জন্য লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তাঁর কাছে যেতে, হয়তো সে তোমাকেই নির্বাচন করত।
রাসুল (সা.) তখন ২৫ বছরের যুবক। ইতিমধ্যেই তিনি চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ব্যবসায় তাঁর সততা ও আমানতকারীর কথাও তখন মানুষের মুখে মুখে। সবার কাছে তিনি তখন ‘আল-আমিন’। তাঁর সুনামের কথা খাদিজার কানেও পৌঁছে।
খাদিজা (রা.) একজন লোকের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.)–এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়ায় যান, অন্যদের তুলনায় তিনি তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মদ (সা.) রাজি হলেন।
খাদিজা (রা.)–র পণ্যসামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মদ (সা.) সিরিয়া গেলেন। রাসুল (সা.) সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেন এবং যা কিছু কেনার ছিল তা কিনলেন। এরপর মক্কায় ফিরে এসে খাদিজার (রা.) পণ্য সামগ্রী বিক্রি করলেন। সেবার ব্যবসায় দ্বিগুণ মুনাফা হয়।
মক্কায় ফিরে আসার পর খাদিজার (রা.) দাস মায়সারা রাসুল (সা.)–এর অনেক প্রশংসা করেন। মায়সারার মুখে সব শুনে খাদিজা (রা.) নিজেই রাসুল (সা.) এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন, যদিও অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবক খাদিজা (রা.)–কে বিয়ের প্রত্যাশী ছিল।
নির্ধারিত তারিখে রাসুলের (সা.) চাচা আবু তালিব ও হামজাসহ রাসূল (সা.) এর পরিবারের আরও কয়েকজন ব্যক্তি খাদিজার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। খাদিজা (রা.)–ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সবার উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। বিয়ের মোহর ধার্য হয় ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা। বিয়েতে খাদিজা (রা.) নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। বেশির ভাগ সিরাত বিশেষজ্ঞদের মতে, বিয়ের সময় রাসুল (সা.) এর বয়স ছিল ২৫ বছর আর খাদিজা (রা.)–র ৪০।
হজরত খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন বিচক্ষণ নারী। তাঁর শোভন আচরণ ও সামাজিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। জাহিলি যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য তিনি ‘তাহিরা’ (পবিত্র) উপাধি লাভ করেন।
বিয়ের ১৫ বছর পর রাসুল (সা.) নবুওয়াত লাভ করেন। ওহি নাজিল হওয়ার পর রাসুল (সা.) শঙ্কিত হয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফেরেন। খাদিজা (রা.)–কে ডেকে বলেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও!’ খাদিজা (রা.) তাঁকে ঢেকে দিলেন। রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)–র কাছে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। তিনি নিজের জীবনের আশঙ্কার কথাও ব্যক্ত করলেন।
খাদিজা (রা.) তখন বললেন, ‘আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরিব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।’
এর পর খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.)–কে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে যান। ওয়ারাকা ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত খ্রিষ্টান আলেম। তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল। সব কথা শুনে তিনি বললেন, এ তো সেই ফেরেশতা, আল্লাহ যাঁকে মুসা (আ.)–এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। যখন তোমার দেশবাসী যখন তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে, তখন যদি আমি বেঁচে থাকতাম! যদি সেসময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করব। (বুখারি) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।
নবুওয়াতের পর রাসুল (সা.)–এর জীবনে চারদিক থেকে বাধা-বিপত্তি, অত্যাচার-নির্যাতন চলতেই থাকে। অবিশ্বাসীদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসুল (সা.) মনে যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদিজার (রা.) কাছে এলে তা দূর হয়ে যেতো। খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.)–কে সান্ত্বনা দিতেন এবং সাহস ও উৎসাহ জোগাতেন। রাসুল (সা.)–এর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন।
খাদিজা (রা.) ছিলেন নবুওয়াতে মুহাম্মদের ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে প্রথম নামাজ আদায়কারী। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তাঁর সব সম্পদ ইসলামের পথে দান করেন।
রাসুল (সা.)–এর স্ত্রীদের মধ্যে খাদিজা (রা.) খুব কঠিন সময়ে তাঁকে একনিষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। নিপুণ দক্ষতায় রাসুল (সা.)–এর সংসার আগলে রেখেছেন।
তাঁদের পঁচিশ বছরের দাম্পত্য–জীবন ছিল চমৎকার! খাদিজা (রা.) বলেছিলেন, তিনি মুহাম্মদ (সা.)–কে ভালোবাসেন তাঁর দয়া, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য।
রাসুল (সা.) ও খাদিজা (রা.)–কে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাঁর বেঁচে থাকাকালে রাসুল (সা.) আর কোনো বিয়ে করেননি।
নবুওয়াতের দশম বছরে ৬৫ বছর বয়সে খাদিজা (রা.) মক্কায় ইন্তেকাল করেন। তাঁকে মক্কার কবরস্থান ‘জান্নাতুল মুয়াল্লায়' দাফন করা হয়।
খাদিজা (রা.)–এর মৃত্যুর পর রাসুল (সা.) প্রায়ই তাঁর স্মৃতিচারণ করতেন। খাদিজার (রা,) মৃত্যুর পর বাড়িতে যখনই কোনো পশু জবাই হতো, রাসুল (সা.) খুঁজে খুঁজে খাদিজার (রা.) বান্ধবীদের বাসায় গোশত পাঠাতেন। সহিহ্ বুখারিতে আছে যে আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.)–এর কাছে গোশত উপহার এলে তিনি খাদিজার বান্ধবীদের বাসায় পাঠিয়ে দিতেন।