ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি সকরুণ স্মৃতিবিজড়িত। আশুরা হলো মহররমের দশম তারিখ। ৬২ হিজরিতে (৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে) এই আশুরার দিনেই শুক্রবার অপরাহ্ণে কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় নাতি হজরত হোসেইন (রা.) নির্মমভাবে শহীদ হন। কারবালা ইরাকের অন্তর্গত কারবালা প্রদেশের রাজধানী শহর। এটি বাগদাদের ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ‘কারবালা’ আরবি ‘কারব+বালা’ দুটি শব্দের সম্মিলিত রূপ। ‘কারব’ অর্থ দুঃখ, সংকট; ‘বালা’ অর্থ বিপদ, মুসিবত।
দশম হিজরিতে প্রিয় নবী (সা.)-এর ওফাতের পর প্রথম খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। তিনি প্রায় আড়াই বছর খেলাফত পরিচালনা করার পর ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুককে (রা.)। তিনি ১০ বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ফজরের নামাজে ইমামতিরত অবস্থায় আততায়ী আবুলুলুর খঞ্জরের আঘাতে শহীদ হন উমর ফারুক (রা.)। মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ইন্তেকালের আগে তিনি হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফকে (রা.) প্রধান করে খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়ে যান। সে কমিটিতে সদস্য ছিলেন হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত তলহা (রা.), হজরত জুবায়ের (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)। হজরত উমর (রা.) এ-ও বলে যান, আবদুল্লাহ ছাড়া এই পাঁচজনের মধ্য থেকেই একজন খলিফা হবেন; আবদুর রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বিবেচিত হবে।
এই মজলিশে শুরা বা উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তেই হজরত উসমান (রা.) তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন।খলিফা উমরের ছোট ছেলে উবায়দুল্লাহ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ হিসেবে আততায়ী আবুলুলু ও তাঁর সহযোগী সন্দেহে আরও দুই নারী-পুরুষকে খুন করেন। খলিফা উসমান (রা.) ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে এই বিচারবহির্ভূত তিন খুনের রক্তপণ দিয়ে বিচারকার্য সমাধা করেন। তিনি সর্বোচ্চ একটানা ১২ বছর খলিফা ছিলেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁর সমাধি অবস্থিত।ইহুদি ও মুনাফিকদের চক্রান্তে ৪০ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর হজরত উসমান (রা.) শুক্রবার দিন আসরের নামাজের পর রোজা অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াতকালে নিজ ঘরে বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হন। তাঁর শাহাদতের পর হজরত আলী (রা.) চতুর্থ খলিফা নিযুক্ত হন। এই সময় চতুর্দিকে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে। হজরত আলী পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় খলিফা হত্যার বিচার করতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় হজরত উমর (রা.) কর্তৃক নিযুক্ত সিরিয়ার দীর্ঘদিনের গভর্নর হজরত মুআবিয়াসহ (রা.) অনেকেই এই খেলাফতের আনুগত্যে অস্বীকৃতি জানান।
একটা অংশ হজরত মুআবিয়াকে (রা.) খলিফা হিসেবে ঘোষণা করলে খেলাফত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তখন হজরত আলী (রা.) প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় খেলাফতের রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফা শহরে স্থানান্তরিত করেন। তিনি প্রায় তিন বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শাসনামলে জঙ্গে জামাল (উষ্ট্র যুদ্ধ) ও জঙ্গে সিফফিন (সিফফিন যুদ্ধ) সংঘটিত হয়। হজরত আলী (রা.) ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে চরমপন্থী খারেজিদের নিয়োজিত গুপ্তঘাতক আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম কর্তৃক তরবারির আঘাতে আহত হয়ে শাহাদতবরণ করেন। ইরাকের নজফে তাঁর মাজার অবস্থিত।চতুর্থ খলিফার শাহাদতের পর তাঁর ছেলে হজরত হাসান (রা.) পঞ্চম খলিফা নির্বাচিত হন। তখন অপর অংশে খলিফা হজরত মুআবিয়া (রা.)। হজরত হাসান (রা.) ছয় মাস খেলাফত পরিচালনা করেন। তিনি অনৈক্যের কুফল ও যুদ্ধের বিভীষিকা অবলোকন করে শান্তির জন্য নিজের খেলাফত ত্যাগ করে অপর অংশের খলিফা হজরত মুআবিয়ার (রা.) সঙ্গে ঐক্যের চুক্তি করেন এবং হজরত মুআবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় খলিফা হবেন, এই শর্তে তাঁকে খেলাফতের সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই সুবাদে হজরত মুআবিয়া (রা.) পূর্ণাঙ্গরূপে পঞ্চম খলিফারূপে পরিগণিত হন। তখন তিনি হজরত হাসান ও হজরত হোসেইনকে নিয়মিত মাসোহারা ও বার্ষিক সম্মানী প্রদান করতেন। এরই মধ্যে হজরত হাসান (রা.) খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ইন্তেকাল করেন। এর দ্বারা হজরত মুআবিয়ার (রা.) সঙ্গে করা চুক্তির অবসান হওয়ায় তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়।অতঃপর হজরত মুআবিয়া (রা.) তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে এসে ৫৬ হিজরিতে নানান বিষয় চিন্তা করে তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শক্রমে নিজপুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করার পূর্বঘোষণা দিলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
তখন তিনি তা আপাতত স্থগিত রাখেন; বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। ৬০ হিজরি সনে হজরত মুআবিয়ার (রা.) ওফাতের পর ইয়াজিদ খলিফা হয়ে সবার আনুগত্য ও নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে হজরত হোসেইনসহ (রা.) অনেকে তাতে অস্বীকৃতি জানান। ইয়াজিদ সিরিয়া থেকে কুফা এবং মক্কা থেকে মদিনা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এই অবস্থায় জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় কুফাবাসী হজরত হোসেইনকে (রা.) মদিনা থেকে আসতে অনুরোধ জানান। হজরত হোসেইন (রা.) ইয়াজিদের শোষণ-নিপীড়ন থেকে জনসাধারণকে রক্ষা ও ইসলামের মূল ধারা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ আহ্বানে সাড়া দেন। অনূর্ধ্ব ৮০ জন সহযাত্রী নিয়ে কারবালার ফোরাতের তীরে এসে ইয়াজিদের অনুচর ইবনে জিয়াদ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন এবং সত্য ও ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত রেখে শাহাদতবরণ করেন।ইমাম দারিমি (রা.) লিখেছেন, হোসেইনের (রা.) হত্যাকারী সিমার ইবন জিলজাওশান। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর হত্যাকারী সিনান ইবন আনাস নাখয়ি, খাওলা বিনতে ইয়াজিদ আসবাহির ও শিবল ইবন ইয়াজিদ। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর ৬ মাস ১৫ দিন।মুহাম্মদ ইবনে সাআদ বলেন, ইয়াজিদ হজরত হোসেইনের (রা.) শির মোবারক মদিনার গভর্নর আমর ইবন সাঈদের কাছে পাঠালে তিনি তা ‘জান্নাতুল বাকি’ কবরস্থানে ফাতেমা (রা.) কবরের পাশে দাফন করেছিলেন। মুহাম্মদ ইবনে উমর ইবনে সালিহর রেওয়ায়াত অনুযায়ী তাঁকে দাফন করা হয় দামেস্ক শহরের বাবুল ফারাদিসে।হোসেইনের (রা.) শির মোবারক নিয়ে আরও প্রচলিত আছে, তাঁর পবিত্র শির ইয়াজিদের নির্দেশে গোলাপজল দিয়ে কয়েকবার ধোয়া হয় এবং কয়েকটি কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়।
তখন ইয়াজিদের রাজদরবারে আসকালান (দক্ষিণ ফিলিস্তিনের অঞ্চল) একদল লোক ছিলেন, তাঁরা তা দাফন করার আগ্রহ ব্যক্ত করলে তাঁদের দেওয়া হয়। তাঁরা তা দামেস্কের আসকালানে দাফন করেন। ১০৯৬ থেকে ১২৯০ সনের মাঝামাঝি ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা মধ্যপ্রাচ্যে হামলা চালালে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে অচিরেই ক্রুসেডাররা আসকালান নগরীতে অবস্থিত হজরত হোসেইনের (রা.) শির উত্তোলন করবে। তাই ফাতেমি শাসকেরা তাঁর মস্তক উত্তোলন করে ৪৫৯ হিজরিতে কায়রো ‘মসজিদে হোসেইন’-সংলগ্ন স্থানে দাফন করেন।‘মাজমুআ ফাতাওয়া’ ২৭তম খণ্ডে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। সেখানে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে, বিশুদ্ধ মত হলো, তাঁর শির মোবারক মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাকিতে তাঁর ভাই, চাচা ও মায়ের পাশে দাফন করা হয়েছে। জুবায়ের বিন বাক্কার ‘কিতাবুল আনসাব’ প্রণেতা, মুহাম্মাদ বিন সাদ ‘তবকাত’ রচয়িতা প্রমুখ উল্লেখ করেছেন যে তাঁর শির মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁকে হজরত হাসানের (রা.) পাশে দাফন করা হয়েছে।
অনেকের মতে, হজরত হোসেইনের (রা.) কবর হজরত আলীর (রা.) কবরের পাশের ফোরাত নদীর তীরে উঁচু ভূমিতে অবস্থিত।ইবনে জারির তাবারি (রা.) ও অন্য ইতিহাসবিদেরা উল্লেখ করেন, হোসেইনের (রা.) শাহাদতের জায়গার চিহ্নটুকু মুছে গেছে, এমনকি কেউ এ নির্দিষ্ট জায়গাটির কোনো তথ্য দিতে পারেননি। যাঁরা হোসেইনের (রা.) কবরের স্থান সম্পর্কে জানেন বলে ধারণা করেন, আবু নুয়াইম ও ফজল ইবনে দিকান তাঁদের দাবি নাকচ করে দেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির (রা.)।মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার বলেছেন: ‘কতলে হোসেইন দর হাকিকত মারগে ইয়াজিদ বুদ, ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কি বাদ।’ অর্থাৎ ‘হোসেইনের (রা.) শাহাদত প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদেরই মৃত্যু (পরাজয়), প্রত্যেক কারবালার পরই ইসলাম সঞ্জীবিত হয়।
’মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।