আল্লাহ তাআলার কুদরত ও নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম মুজিজা হলো মিরাজ। মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়তের ১১তম বছরে, রজব মাসের ২৭ তারিখে। তখন নবীজির বয়স ৫১ বছর। এ বছর নবীজির চাচা আবু তালিব মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে নবীজির সহধর্মিণী হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর ওফাত হয়। ঘরে-বাইরে এই দুজন নবীজির অতি প্রিয় ও জীবনের বড় অবলম্বন ছিলেন। একই বছর প্রধান দুই প্রিয়ভাজন ও অবলম্বন হারিয়ে নবীজি খুবই বিচলিত হন। তাই এ বছরকে আমুল হুজন বা ‘দুশ্চিন্তার বছর’ বলা হয়। প্রিয় নবী (সা.)-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ও স্বীয় রহস্যলোক দেখানোর জন্য আল্লাহ তাআলা স্বীয় হাবিবকে মিরাজে নিয়ে যান। যে রাতে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল, তাকে শবে মিরাজ বা মিরাজ রজনী বলা হয়।
সশরীর ও জাগ্রত অবস্থায়ই মিরাজ হয়েছিল। এর বড় প্রমাণ হলো অবিশ্বাসী কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাস। যদি আধ্যাত্মিক বা রুহানিভাবে অথবা স্বপ্নযোগে হওয়ার কথা বলা হতো, তাহলে তাঁদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ নক্ষত্রের, যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথি (মুহাম্মদ সা.) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু নয়)। তঁাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট। সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি, যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর, যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাঁকে, যা তিনি দেখেছেন, সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন, তিনি তাঁকে দ্বিতীয় অবতরণস্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা, যা ঢেকেছে, না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে, আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় নিদর্শনসমূহ।’ (সুরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ১-১৮)।
মিরাজের একটা অংশ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাতের সময়ের ভ্রমণ। যেহেতু নবী করিম (সা.)-এর মিরাজ রাতে হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। বিশেষত বায়তুল্লাহ শরিফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি পবিত্র (আল্লাহ), যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিকালীন ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাঁকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ১)।
মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। আরবি পরিভাষায় মিরাজ হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক সশরীর সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.) সমভিব্যাহারে বুরাক বাহনে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে দিদার লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা। মিরাজ ভ্রমণে প্রিয় নবী (সা.) প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহিয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন।
প্রত্যেকের সঙ্গে সালাম কালাম ও কুশল বিনিময় হয়। তিনি বায়তুল মামুর গেছেন, যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা আসেন ও প্রস্থান করেন; তাঁরা দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ পান না। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে যান। তারপর তিনি বায়তুল মামুরে পৌঁছান।
মিরাজ রজনীতে হাবিব ও মাহবুবের এই একান্ত সাক্ষাতে যে বিষয়গুলো ঘোষণা হয়: আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, নিকট স্বজনদের অধিকার দিতে হবে; মিসকিন ও পথসন্তানদের (তাদের অধিকার দিতে হবে); অপচয় করা যাবে না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই; কৃপণতা করা যাবে না; সন্তানদের হত্যা করা যাবে না; ব্যভিচারের ধারেকাছেও যাওয়া যাবে না; মানব হত্যা করা যাবে না, (আত্মসাতের উদ্দেশ্যে) এতিমের সম্পদের কাছেও যাওয়া যাবে না; প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে হবে; মাপে পূর্ণ দিতে হবে; তা করা বা বলা যাবে না যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই; পৃথিবীতে গর্বভরে চলা যাবে না। এসবই মন্দ, তোমার রবের কাছে অপছন্দ। (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ২২-৪৪।)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com