লুইস হেনরি জর্ডান মনে করেন, ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব হচ্ছে এমন বিদ্যা, যা বিভিন্ন ধর্মের মৌলিক মিল-অমিল, সম্পর্কের মাত্রা ও পর্যায়, ভালোমন্দের মান ও উৎস, কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে তুলনা করে।’ ‘থিওলজি’ শব্দটি গ্রিক ‘থিওজ’ অর্থাৎ ঈশ্বর এবং ‘লগোজ’ অর্থাৎ তত্ত্ব শব্দ থেকে উদ্ভূত। থিওলজিকে আমরা ঈশ্বরতত্ত্ব বলি, যা পরবর্তী সময়ে ধর্মতত্ত্বরূপে পরিচিতি পেয়েছে। ধর্মতত্ত্ব বলতে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের তরফ থেকে ধর্মের স্বরূপ ও আচার–অনুষ্ঠানাদিকে বুদ্ধির আলোকে অনুধাবন ও উপলব্ধি করার প্রচেষ্টাকে বোঝায়। ধর্মের স্বরূপ, ক্রিয়া, জীবনে ধর্মীয় চেতনার ভূমিকা, উপযোগিতা প্রভৃতির আলোচনা ও পর্যালোচনাই ধর্মতত্ত্বের কাজ। এ তত্ত্ব যখন সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বিভিন্ন বিশ্বাসের গতি–প্রকৃতি ও কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে, তখনই তাকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বলা হয়।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব হলো ধর্ম নিয়ে গবেষণার বিভিন্ন শাখার মধ্যে অন্যতম একটি শাখা। এটা পৃথিবীর ধর্মগুলোর বিভিন্ন আইনকানুন ও বিধিবিধানের তুলনামূলক আলোচনা করে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধর্মের অভ্যন্তরীণ মৌলিক দর্শন যথা নৈতিকতা, অধিবিদ্যা ও চিরমুক্তির ধারণা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দান করে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান একজন মানুষকে আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জনে সহায়তা করে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বকে আরবিতে ‘মুকারানাতুল-আদইয়ান’ এবং ইংরেজিতে ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ বলে অভিহিত করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় উৎস, কাঠামো, বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, মূল্যবোধ, দর্শন অনুসন্ধান করে উদার ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার ও উপাদানের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিষয়গুলোকে সুচিন্তিতভাবে চিহ্নিত করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রচেষ্টা সর্বদাই ছিল। চার্লস জোসেফ অ্যাডামস মনে করেন, ধর্মগুলোর বিভাজনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ভৌগোলিক বিভাজনের লক্ষণীয় ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর মানুষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করাই তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কাজ। মিসরীয় ধর্মতত্ত্ববিদ আহমদ সালাবিও একই কথা বলেছেন।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সর্বদাই ক্রিয়াশীল। বিশেষ করে মুসলিম স্কলাররা মনে করেন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চা মানেই নিজের ধর্মকে খাটো করা বা অন্যদের প্রতি ঝুঁকে যাওয়া। এ ধারণা একেবারেই বিভ্রান্তিকর। কিন্তু ইসলামের সত্যিকার ইতিহাস এ কথা বলে না। রাসুল (সা.) এককভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করে অমুসলিমদের সঙ্গে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় তাদের নতুন ধর্মের সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন। প্রথম দিকে ইসলাম প্রচারে অনেক অমুসলিমের সহযোগিতা রয়েছে।
পবিত্র কোরআনেও এ ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা ও সহাবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘কিতাবধারীদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে কেবল উত্তম পন্থায় (ভদ্রভাবে ও যুক্তিসহকারে) বিতর্ক করবে; তবে তাদের মধ্যে যারা জালেম, তাদের সঙ্গে নয়। আর বলবে, আমাদের কাছে যা নাজিল করা হয়েছে (কোরআন) এবং তোমাদের কাছে যা নাজিল করা হয়েছে (তাওরাত ও ইঞ্জিল), আমরা তা বিশ্বাস করি। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য একজনই (আল্লাহ) এবং আমরা তাঁরই অনুগত’ (সুরা আনকাবুত: ৪৬)। রাসুল (সা.) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেছেন। এমন অসংখ্য ঘটনা ও জীবন–সম্পর্কিত তথ্য হাদিস সংকলনে ও ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। সিরাতে ইবনে হিশাম রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী আদি ইবনে হাতেমের বিতর্কের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, যিনি একপর্যায়ে রাসুল (সা.)-এর ধর্মতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এমনিভাবে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিক মাহসুর বিন সুবহানের ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার কথা উল্লেখ করা যায়। উভয়ের মধ্যে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়। আলোচনার একপর্যায়ে মাহসুর বিন সুবহান রাসুলুল্লাহকে পবিত্র কোরআন যে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এর প্রমাণ পেশ করতে অনুরোধ করেন। জবাবে রাসুল (সা.) পবিত্র কোরআন থেকে বলেন: তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না? এই কোরআন যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে আসত, তাহলে তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত (সুরা নিসা: ৮২)। রাসুল (সা.) ও ইহুদিদের মধ্যে এমনিভাবে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এসব বিতর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে নাজরানের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা বা বিতর্কের কথাটি উল্লেখ করা যায়। উল্লিখিত সব বিতর্কের মধ্যে সহাবস্থান ও পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। নিবিড় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এ পরিবেশের মধ্যে খোলামেলা আলোচনায় অনেক ইহুদি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ বিন সালাম, সায়লাবা বিন সায়িদ ও আসাদ বিন আবিদ অন্যতম। আর যারা ইসলামে আসেনি, তাদের অধিকাংশই সমাজে ইসলামি পরিবেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান অব্যাহত রেখেছিল। তবে কিছু ষড়যন্ত্রকারীর ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল।
পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.)–এর কার্যক্রম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তী মুসলিম পণ্ডিতেরা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব চর্চাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে মুসলিম পণ্ডিতেরা তফসির, হাদিস ও ফিকাহ বিজ্ঞান গবেষণা ও সংকলনের কাজ শুরু করার সময় থেকেই কতিপয় ইসলামি পণ্ডিত তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চায় ব্রতী হন। ফলে, অন্যান্য ইসলামি জ্ঞানের সঙ্গে এ বিষয়ও ইসলামি জ্ঞানচর্চার একটি অংশ বলে বিবেচিত হয়। যেসব ইসলামি পণ্ডিত ধর্মতত্ত্বের চর্চায় ব্রতী হন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আন-নাওবাখতি। তাঁর লিখিত কিতাবের নাম ‘আল-আরা ওয়াদ দিয়ানাত’ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে প্রথম বই, যাতে বিভিন্ন ধর্মের ওপর বিস্তর আলোচনা এসেছে। আল-মাসউদি লিখিত ‘আদ-দিয়ানাত’, আল-মাযহাবি (৪২০ হি.) লিখিত ধর্মতত্ত্বের ওপর তিন হাজার পৃষ্ঠাসংবলিত সবচেয়ে বড় গ্রন্থ ‘দারকুল বাগয়াতি ফি ওয়াসফিল আদিয়ান ওয়াল ইবাদাহ’ প্রকাশিত হয়। ধর্মতত্ত্বের এ বিষয়ের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেন আবু মনসুর বাগদাদি (৪২৯ হি.)।
তাঁর লিখিত কিতাবের নাম ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’। এ বিষয়ে লিখিত ইবনে হাজাম আন্দালুসির (৪৫৬ হি.) ‘আল-ফাসলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নেহাল’, শাহরেস্তানির (৫৪৮ হি.) ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থ অন্যতম। এখানে আবু রায়হান আল-বিরোনির (৪৪০ হি.) লিখিত ‘তাহকিকু মা লিল হিন্দ মিন মাকুলাতিন-মাকবুলাতুন ফিল আকলে আও মারজুলাতিন’ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
হিন্দুধর্মের ওপর লেখা বইটির লেখক অত্যন্ত পরিশ্রম করে হিন্দুধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস, অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন উপদল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। ইসলামি পণ্ডিতদের এরূপ ব্যাপক গবেষণা ও পর্যালোচনায় তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিষয়টি ইসলামি জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোই উন্নীত হয়। কেউ কেউ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বকে ইসলামি জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। ওরিয়েন্টালিস্ট অ্যাডাম ম্যাজও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ইসলামি বিষয় বলে মনে করেন।
জ্ঞানের এ শাখা উদ্ভবের ফলে মুসলিমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে যে সৌজন্য ও বদান্যতা প্রকাশ করেছেন, মধ্যযুগে এর দৃষ্টান্ত বিরল। বিষয়টি দ্বারা তাঁরা অন্য ধর্মকে হেয় করেননি, বরং উদার, নিরপেক্ষ, তাত্ত্বিক ও বর্ণনামূলক পর্যালোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু কেবল ধর্মীয় স্তুতি আওড়ানোকে ইসলামি জ্ঞান বলে ঘোষণা দিয়ে বিশ্বসভ্যতার নেতৃত্ব থেকে মুসলমানদের পিছিয়ে দিয়ে যে সর্বনাশ করা হয়েছে, সেখান থেকে এ জাতির কবে উত্তরণ হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
* মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন: অধ্যাপক, দাওয়া অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।