কালীপূজার উৎপত্তি

কালী শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রী রূপ, যার অর্থ হলো কৃষ্ণবর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মা কালী মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ। আবার প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে এক দেবীর উল্লেখ আছে, যিনি হত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মা বহন করেন, যাঁর নাম কালরাত্রি বা কালী। নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক, যাঁর নাম কৃষ্ণানন্দ, তিনি বাংলায় প্রথম কালীর মূর্তি বা প্রতিমাপূজার প্রচলন করেন। তার আগে উপাসকেরা তাম্রপটে বা খোদাই করে কালীর সাধনা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, কৃষ্ণানন্দ বাবু কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের কারণে কালীপূজা বাঙালিদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়েছে।

মা কালীর উৎপত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা

সনাতনধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী, মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো, পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই দৈত্য পৃথিবীজুড়ে তাদের ভয়ংকর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন, তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন। সেই দেবীই হচ্ছেন কালী।

আরেক আখ্যানমতে, স্বর্গ তোলপাড় করে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে অসুরের দল। দেবতাদের তাড়িয়ে স্বর্গরাজ্যের দখলের চেষ্টাও করছে তারা। দেবতাদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব। অসুরদের প্রধান রক্তবীজের ছিল ব্রহ্মার বর। যার জেরে রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত ভূতলে পতিত হলেই তা থেকে জন্ম নিচ্ছিল একাধিক অসুর। এমন পরিস্থিতি থেকে স্বর্গকে রক্ষা করতে এবং দেবতার মানসম্মান রক্ষার্থে অবতীর্ণ হন দেবী দুর্গা। সব অসুর দেবী দুর্গার হাতে নিহত হলেও ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত রক্তবীজে বারবার বেঁচে যায়। ক্রোধান্বিত দেবী দুর্গা তাঁর ভ্রু যুগলের মাঝ থেকে জন্ম দেন কালীকে। কালীর ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি আর নগ্নিকা রূপে নিহত হতে থাকে একের পর এক অসুর। রক্তবর্ণ লকলকে জিভ বের করে কালী গ্রাস করে নিতে থাকেন একের পর অসুর এবং তাদের রণবাহিনীকে। হাতি, ঘোড়াসমত অসুরের দলকে কালী গ্রাস করতে থাকেন। রক্তবীজকে অস্ত্রে বিদ্ধ করে তার শরীরের সব রক্ত পান করে নেন কালী। রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে, সে জন্য কালী তাকে শূন্যে তুলে নেন। রক্তবীজকে এক্কেবারে রক্তশূন্য করে দেহ ছুড়ে ফেলে দেন।

কালীর পায়ের তলায় শিব কেন

অসুরদের হারানোর পর প্রবল বিজয়নৃত্য শুরু করেন কালী। অসুরের মুণ্ড দিয়ে বানান কোমরবন্ধ ও গলার মালা। কালীর উন্মাদ নৃত্যে স্বর্গে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। দেবতারা আবার গেলেন মহাদেবের কাছে। কারণ, কালীর নৃত্যে সৃষ্টি–স্থিতি ধ্বংস হওয়ার মুখে। মহাদেব নিজেই ছুটলেন কালীর নৃত্য বন্ধ করতে। কিন্তু মহাদেবের হাজারো কথাও শুনতে পেলেন না উন্মাদিনী কালী। উপায়ান্তর না দেখে মহাদেব এবার কালীর পায়ের তলায় নিজেকে ছুড়ে ফেলে দেন। পায়ের নিচে স্বামীকে পড়ে থাকতে দেখে লজ্জিত হন কালী। লজ্জায় জিব কাটেন তিনি। পৌরাণিক এ কাহিনি অবলম্বনে পূজিত হয়ে আসছেন কালী। তাই কালী রূপ মানেই তাঁর নগ্ন রূপ আর অসুরদের ধরহীন মুণ্ডর কোমরবন্ধনী ও মালার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলায় শিব।

দেবীর গায়ের রং কালো কেন

আসলে তিনি যেকোনো বর্ণের অতীত। আর কালো রং সব বর্ণের অনুপস্থিতির প্রতীক। কখনো দেবীকে গাঢ় নীল বর্ণেও কল্পনা করা হয়। তিনি গাঢ় নীল আকাশের মতোই অসীম। তাঁর নীল গাত্রবর্ণ সেই গগণসম অসীমতার ইঙ্গিতবাহী।

কালী ত্রিনয়না

কালীর তিনটি নয়ন বা চোখ। এই ত্রিনয়ন চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নির মতো অন্ধকার বিনাশকারী। এই ত্রিনয়নের মাধ্যমে দেবী যেমন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শন করে থাকেন, তেমনই প্রত্যক্ষ করেন সত্য, শিব ও সুন্দরকে; অর্থাৎ বৃহত্তর অর্থে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কে।

দেবী দিগম্বরী

তিনি বিশ্বব্যাপী শক্তির প্রতীক। তিনি অসীম। এই চিরশক্তিকে আবৃত করে এমন সাধ্য কোন বস্ত্রের রয়েছে! দেবী তাই দিগম্বরী।

পাঁঠা বলি

কালীপূজার সঙ্গে পাঁঠা বলির কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এক শ্রেণির মত অনুযায়ী, তমোগুণসম্পন্ন (তমো শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার এবং তম থেকেই তামসিক শব্দের উৎপত্তি) মানুষদের জন্য বলি প্রথা, যার বিধান হলো অমাবস্যার গভীর রাতে মহামায়ার উগ্ররূপা কালী প্রতিমার সামনে পাঁঠা বলি দিয়ে তার মাংস ভক্ষণ করা হয়। শাস্ত্রের এই বিধান মাংসাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই।

তবে কালীপূজার সঙ্গে পাঁঠা বলি, পটকা ফোটানো আর সুরা পানের কোনো শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নেই। ভোজনবিলাসী, আওয়াজসর্বস্ব সুরা পিয়াসীরা নিজ গরজে এমন প্রথা চালু করেছেন বলে মনে হয়।

কালীপূজায় কেন জবা ফুল লাগে

লাল রং শক্তি ও শৌর্যের প্রতীক। মা কালী স্বয়ং শক্তির রূপ, তাই তাঁকে শক্তিরূপিণী দেবীও বলা হয়ে থাকে। তাই কালীপূজা জবা ফুল ছাড়া হয় না। সারা পৃথিবীই এই শক্তির উপাসনা করে ‘শক্তপ্রাপ্ত’ হয়েছে!