বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম দুর্গাপূজা। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন; অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব হয়। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত।
দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কী? সেই প্রাচীন যুগে দেবী এল কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী মাহাত্ম্য’-এ (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে!
দুর্গা নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীপ্রতিমা। তাঁর ১০ হাতে ১০ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকেলে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পেছনে চালচিত্রে আরও নানা রকম ঠাকুর-দেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরা প্রতিমার মাথার ওপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিব ঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই প্রতিমা বছরের পর বছর ধরে দেখে আমরা অভ্যস্ত।
দেবী দুর্গা ও তাঁর সহযোগী দেব-দেবীদের নিয়ে গল্প-কাহিনির শেষ নেই। তাঁর উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। গবেষক-পণ্ডিত প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে বয়ান দিয়েছেন, নিজেদের মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের মত’ বলেও কোনো কিছু গ্রহণ করার মতো বাস্তবতা নেই। কোন মত বেশির ভাগ পণ্ডিত দ্বারা সমর্থিত, সেটাও একটা ধাঁধা!
নানা সময়ে দুর্গাপূজা প্রচলনের নানা কাহিনি শোনা যায়। কালিকা পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য দখল করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি তখন অবধ্য। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতার সমবেত তেজ থেকে যে ‘দুর্গা’ নামের নারীমূর্তিরূপে আবির্ভূত হন, সেই শক্তিই বিনাশ করেন অসুরকে। ত্রেতা যুগে রাবণ চৈত্র মাসে এই পূজা করতেন। পরে পূজার নামকরণ হয়েছিল অকালবোধন। অকালে পূজা বলেই যেন বেশি আদর। তা-ও আবার রাবণবধের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের পূজা।
পুরাণে অবশ্য এসব বৃত্তান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্গার সঙ্গে ‘আত্মীয়’-এর মতো আরও যেসব দেব-দেবী দেখা যায় তাঁরা হলেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। ওপরের দিকে কখনো কখনো ছোট্ট করে শিবের প্রতিমাও থাকে। প্রচলিত ধারণা আছে যে এ যেন শিব-দুর্গার সংসার, দুই পাশে তাঁদের চার ছেলে-মেয়ে! এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওই চার দেব–দেবী মোটেই পরস্পরের ভাই-বোন নন। আর দুর্গার পক্ষেও কোনো সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ছিল না।
সরস্বতী কী করে দুর্গার মেয়ে হবেন? তিনি দুর্গার চেয়ে বয়সে বড়। সরস্বতীর দেখা পাই আমরা আমাদের সভ্যতার উষালগ্নে, যখন ঋগ্বেদ রচিত হচ্ছে। তখন যজ্ঞের সময় একসঙ্গে তিন দেবীকে আহ্বান করা হতো। ইলা, ভারতী ও সরস্বতী। তাঁরা প্রথমে আলাদা ছিলেন, একসময় ইলা (ইরা) কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, আর ভারতীও ক্রমে মিশে গেলেন সরস্বতীর সঙ্গে।
সরস্বতী দেবী আবার নদীরূপাও বটে। নামের অর্থেই তাঁর পরিচয়। অবশ্য ‘সরস’ শব্দের অন্য অর্থ জ্যোতি; অর্থাৎ তিনি জ্যোতির্ময়ী। ক্রমে নদীরূপটিই প্রাধান্য পায়। সেকালে গঙ্গার উল্লেখ খুবই কম, আর্য সভ্যতায় সিন্ধু এবং সরস্বতীই দুই প্রধান নদী। সরস্বতীর তীরে বহু যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। প্রসিদ্ধ রাজারা এর দুই তীরে বাস করতেন। গড়ে উঠেছিল বহু নগর ও তীর্থস্থান।
একসময় কোনো অজ্ঞাত কারণে এই সরস্বতী নদী অন্তর্হিত হয়ে যায়। পরিণত হয় মরুভূমিতে। তখন তিনি ছিলেন ধনদাত্রী, অন্নদাত্রী।
সব দেব-দেবীরই বিভিন্ন যুগে নানা বিবর্তন হয়েছে। ঋষিরা তো এক জায়গায় বসে, কমিটি গঠন করে দেব-দেবীদের নির্দিষ্ট রূপ ও গুণাবলির কথা রচনা করেননি। নানাজনে আলাদা আলাদাভাবে ইচ্ছেমতো শ্লোক লিখেছেন। যুগ যুগ ধরে সেই সব পৃথক ভাবমূর্তি একটি মিলিত রূপ পেয়েছে।
আজকের যে সরস্বতীকে বাক্দেবী বলে মনে করা হয়, আদি যুগে তিনি তা ছিলেন না। নদী রূপে তিনি মানুষের অন্ন ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আরাধ্যা হয়েছেন। আবার দেবীরূপে তিনি যুদ্ধও করেছেন দানবদের বিরুদ্ধে। তখন লক্ষ্মীও আসেননি, দুর্গাও আসেননি। তাঁদের দুজনের ভূমিকাও সরস্বতীকে কিছুটা পালন করতে হয়েছিল।
সরস্বতীর নানা গুণের কথা বলা হলেও তাঁর প্রতিমা স্পষ্ট ছিল না। শুধু বলা হতো, তিনি শুভ্রবর্ণা। কালপ্রবাহে সরস্বতীর জন্ম সম্পর্কেও বিভিন্ন গল্প প্রচলিত হয়েছে। কোনো পুরাণে তিনি ব্রহ্মার কন্যা; ব্রহ্মার মুখ থেকে নির্গত হয়েছিলেন। জন্মমাত্রই যুবতী, এই কন্যার রূপ দেখে কামমোহিত ব্রহ্মা তাঁর মিলন চান। ব্রহ্মার পুত্ররা এ জন্য ছি ছি করায় ব্রহ্মা শেষ পর্যন্ত অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে আত্মহত্যাই করে বসেন। ব্রহ্মার অপর নাম পরমেষ্ঠী; অর্থাৎ সরস্বতী ব্রহ্মার পত্নী। আর একটি শ্লোকে সরস্বতী বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গিনী এবং সরস্বতী শিবেরও স্ত্রী, এমন উল্লেখও আছে; অর্থাৎ প্রধান তিন দেবতার সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক আছে। আগেই বলা হয়েছে, নানা মুনির নানা মত। তবে বাঙালিরা কী করে এই সরস্বতীকে শিব-দুর্গার কন্যা বানিয়ে ফেলেছেন, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
লক্ষ্মীর আগমন আরেকটু পর। অনেকেরই ধারণা, সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে আসেন লক্ষ্মী। কিন্তু লক্ষ্মী সমুদ্রের অতলে গেলেন কী করে? এ সম্পর্কেও একটা কাহিনি আছে। দুর্বাসা মুনি, যিনি শুধু অভিশাপ দেওয়ার জন্যই বিখ্যাত, তাঁর অন্য কোনো গুণের কথা বিশেষ জানা যায় না। তিনি এক দিন একটি ফুলের মালা উপহার দিলেন ইন্দ্রকে। ইন্দ্র অমন ফুলের মালা অনেক পেয়েছেন, তিনি অন্যমনস্কভাবে মালাটি রেখে দিলেন ঐরাবতের মস্তকে। ঐরাবতের বোধ হয় মালাটি পছন্দ হয়নি, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা সে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর পা দিয়ে চেপ্টে দিল। ব্যাস! রগচটা স্বভাবের ঋষি অমনি জ্বলে উঠে উচ্চারণ করলেন অভিশাপ। অদ্ভুত সেই অভিশাপ। তিনি বললেন, ‘কী! আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে।’ অর্থাৎ লক্ষ্মীর নির্বাসন। দোষ করলেন ইন্দ্র, শাস্তি পেতে হবে লক্ষ্মীকে। সাধে কি আর নারীবাদীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ওপর এত ক্ষিপ্ত! অগত্যা লক্ষ্মীকে লুকাতে হলো সমুদ্রে।
পরে দেবতাদের ব্যাকুল প্রার্থনায় বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন সমুদ্রমন্থনের। মন্থনের পর যিনি রত্নাকর থেকে উত্থিত হলেন, তিনি কিন্তু লক্ষ্মী নন। সেই দেবীর নাম শ্রী। এই শ্রী ও লক্ষ্মী দুই পৃথক দেবী ছিলেন। বেশ কিছুকাল পর দুজনে মিলেমিশে এক হয়ে যান। লক্ষ্মী দেবী ছিলেন মহর্ষি ভৃগুর কন্যা, মায়ের নাম খ্যাতি। লক্ষ্মী ও শ্রী একাকার হয়ে বিষ্ণুর পত্নী হন। সেই লক্ষ্মীই কী করে ইন্দ্রের পাশে থাকেন? এসবই দেব-দেবীদের ধারণার নানা রকম বিবর্তনের ফল।
দুর্গা তো কারও মা হতেই পারেন না। কয়েকটি পুরাণমতে, তিনি শিবের স্ত্রীও নন। মহিষাসুর নামে অসুরকে ব্রহ্মা বর দিয়ে ফেলেছিলেন যে কোনো পুরুষ তাঁকে বধ করতে পারবেন না। এরপর তিনি মনের আনন্দে দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলেন। উত্ত্যক্ত, ব্যতিব্যস্ত দেবতারা দেখলেন, এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। তাঁরা নিজেরা কেউ এই দানবের সঙ্গে লড়তে পারবেন না, এক প্রবল শক্তিশালিনী নারীকে সৃষ্টি করতে হবে। তখন অনেকেই তাঁদের তেজের অংশ দান করলেন।
শিবের তেজে হলো মুখ, বিষ্ণুর তেজে ১০টি বাহু, চন্দ্রের তেজে ২ স্তন, ইন্দ্রের তেজে কোমর, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, বসুগণের তেজে আঙুল, কুবেরের তেজে নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, সন্ধ্যার তেজে দুই ভুরু ও পবনের তেজে দুই কান। এই গঠনপ্রক্রিয়ায় বেশ একটা কৌতূহলী দিক আছে।
শিবের তেজে এল রমণীটির মুখ, অথচ সেই মুখে ভুরু ও কান ছিল না? বিষ্ণু দিলেন ১০টা হাত, তাতে আঙুল জোড়া হলো পরে? এ যেন কুমারের প্রতিমা গড়া! অবশ্য বিভিন্ন পুরাণে এর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা আছে। যা-ই হোক, হিমালয় থেকে একটা সিংহ নিয়ে (সিংহ অবশ্য পাহাড়ি পশু নয়) দেবী গেলেন দানবনিধনে। এই দেবীরই অন্য নাম চণ্ডী ও কাত্যায়নী। কোনো কোনো অঞ্চলে কাত্যায়নী নামটিই বেশি জনপ্রিয়, বাংলায় দুর্গা। কাজ শেষ হলে এই দেবী দেবতাদের বললেন, ‘আমি ফিরে আসব,’ তারপর শিবের পাদমূলে মিলিয়ে গেলেন। ফিরে আর আসেননি।
দেবী দুর্গার সেই রণরঙ্গিণী মূর্তি, তাঁর সঙ্গে আর চারজন দেবতাকে জুড়ে দিয়ে যে পূজা, তা-ই বাঙালি হিন্দুদের কাছে কী করে প্রধান উৎসব হয়ে দাঁড়াল, তার উত্তর পাওয়া দুষ্কর। অনেকে মনে করেন, এটা ভাবপ্রবণ বাঙালির নিজস্ব সৃজনশীলতা! বাংলার কাব্য-গানে কিন্তু হিমালয়–দুহিতা উমা বা পার্বতীরই প্রাধান্য। পতির নিন্দায় অপমানিতা সতী প্রাণত্যাগ করে হিমালয়ের কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে শিবকেই আবার স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য দুস্তর তপস্যা করেন (নির্জলা উপবাস, কোনো গাছের পাতাও খেতেন না, তাই তাঁর আরেক নাম অপর্ণা)।
আমাদের আগমনী গানে থাকে, ‘যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী, উমা কত মা মা বলে কেঁদেছে’। এ যেন বাংলারই মেয়ে। কিন্তু উমা বা পার্বতীর প্রতিমা গড়িয়ে পূজা করা হয় না। যুদ্ধবিদ্যায় বাঙালি হিন্দুর তেমন খ্যাতি নেই, তবু তাঁরা দুর্গা এবং কালীর সংহার মূর্তির বেশি ভক্ত।
বিস্ময় আরও আছে, অত বড় দেবতা গণেশ, যাঁর বাহন সামান্য একটা ইঁদুর! যেমন অমন রূপসী লক্ষ্মী দেবীর বাহন একটি প্যাঁচা! এতে যেন ঔচিত্যবোধের খুবই অভাব। এসব বাহনের রূপকার্থ নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা তো হতেই পারে। আছেও। লক্ষ্মীপ্রতিমার বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায়, নানা সময়ে তাঁর বাহন ছিল ময়ূর, কূর্ম, সিংহ ও হাঁস। কোনোটাকেই তিনি ধরে রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত জুটেছে প্যাঁচা!
এই প্যাঁচা সম্পর্কে পণ্ডিতদের একটি মত আছে। বিষ্ণুর বাহন গরুড় আর বিষ্ণুপ্রিয়ার বাহন সেই গরুড়েরই ক্ষুদ্র সংস্করণ প্যাঁচা। প্যাঁচার মুখের সঙ্গে গরুড়ের খানিকটা মিল আছে, ঠিকই। তাহলে গণেশ বাহন ইঁদুরও হতে পারে হাতির অতি ক্ষুদ্র বংশধর। সেই যে গল্পে আছে, হবুচন্দ্র রাজা জীবনে কোনো দিন শূকর দেখেননি। প্রথম ওই প্রাণী দেখে তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মন্ত্রী, ওটা কী?’
মন্ত্রীদের সবজান্তা হতেই হয়। তিনিও আগে কখনো শূকর-দর্শন করেননি, তবু চটপট উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, খুব সম্ভবত ওটা একটা হাতি, শুঁড়টুড় খইয়ে ফেলে ছোট হয়ে গেছে, কিংবা একটা ইঁদুর অনেক বড় হয়ে উঠেছে (গজক্ষয় অথবা মূষিক বৃদ্ধি)!’
হিন্দু দেব-দেবীদের বিবর্তনের ইতিহাস, একের সঙ্গে অন্যদের মিশে যাওয়া ইতিহাস, যা খুবই আকর্ষণীয়। প্রশ্ন হলো, বিবর্তিত হতে হতে দেব-দেবী কি তাহলে দুনিয়া থেকে উঠে যাবেন? ভলতেয়ার বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত দিন দারিদ্র্য থাকবে, তত দিন ধর্মকে একেবারে মুছে ফেলা যাবে না।