জীবের দুর্গতি নাশ করেন দুর্গা

দুর্গা পৌরাণিক দেবী। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করায় তাঁর নাম দুর্গা। আবার জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলে তাঁকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে তখন সব দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে দুর্গার জন্ম হয়। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে তিনি যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। এ থেকে তাঁর আরেক নাম হয় মহিষমর্দিনী। পুরাণমতে, দুর্গা মহাদেব বা শিবের স্ত্রী। তাঁর গায়ের রং অতসী ফুলের মতো সোনালি হলুদ। তিনি দশভুজা ও ত্রিনয়নী। তাঁর বাহন সিংহ। দেবীপুরাণ, দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ, দুর্গোৎসব বিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গা সম্পর্কে বর্ণনা আছে। পুরাণে উল্লেখিত আছে যে পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত বৈশ্য সমাধি মেধস মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে তাঁর পরামর্শে উভয়ই দেবী দুর্গা বা ভগবতীর পূজা করেন। পূজায় তুষ্ট হয়ে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন দুর্গা।

কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকাল শরতে দেবীর পূজা করেছিলেন বলে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা। লঙ্কারাজ রাবণ চৈত্র মাসে দুর্গাপূজা করতেন। বসন্তকালে দুর্গাপূজা হলে তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ সর্বত্র বাঙালিরা সাধারণত শরৎকালেই দুর্গাপূজা করেন। বাসন্তী পূজা হয় চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে আর শারদীয় পূজা হয় আশ্বিন বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। শুক্লার ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে (মহানবমী) পূজা দিয়ে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। ওই দিন কোথাও কোথাও দশোহরার মেলা হয়। পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নতুন পোশাক পরে। তা ছাড়া আলিঙ্গন, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদির মাধ্যমে তারা একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। দশোহরার মেলার দিন নৌকাবাইচ হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে, যেমন কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা প্রভৃতি নামে দেবী দুর্গার পূজা হয়।

দেবী দুর্গার অপর নাম চণ্ডী

হিন্দু পুরাণমতে দেবী দুর্গার অপর নাম চণ্ডী। মার্কণ্ডেয় পুরাণ–এর অন্তর্ভুক্ত দেবীর মাহাত্ম্যকথাকেও চণ্ডী বলা হয়। এতে মোট ৭০০ শ্লোক আছে। দেবী চণ্ডী যখন ভক্তের দুর্গতি বিনাশ করেন, তখন তাঁকে বলা হয় দুর্গা। দুর্গারূপে তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। বহু নামে চণ্ডী পূজিত হন, যেমন দেবী চণ্ডী, জয়চণ্ডী, ওলাইচণ্ডী, কুলুইচণ্ডী, চেলাইচণ্ডী প্রভৃতি। জয়চণ্ডীরূপে তিনি দ্বিভুজা, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, বরাভয়হস্তা এবং পদ্মোপরি দণ্ডায়মানা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দুর্গা অর্থাৎ অরণ্যানী চণ্ডীর মাহাত্ম্য গীত হয়েছে। এতে তিনি ‘অভয়া মঙ্গলচণ্ডী’ নামে বর্ণিত। তাঁর বাহন গাধা বা গোসাপ। বাংলার নারী সমাজ মঙ্গলচণ্ডীকে গৃহকল্যাণের প্রধান দেবতাজ্ঞানে পূজা করেন। সধবা নারী জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে ফলাহার করেন এবং দেবীর ব্রতকথা শোনেন। হিন্দু পরিবারে প্রত্যেক নববধূর একটি করে মঙ্গলচণ্ডীর ‘ঝাঁপি’ থাকে। চণ্ডীকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা ও বিশ্বাস করা হয়, যেমন শেওড়াগাছে অধিষ্ঠিত দেবীকে বলা হয় বনদুর্গা, পাকুড়গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ষষ্ঠী, বসন্ত রোগের উপশমকারী দেবী বসন্তচণ্ডী বা বসন চণ্ডী ইত্যাদি। যখন মানত হিসেবে দেবীর অধিষ্ঠান ক্ষেত্ররূপে কল্পিত গাছের কোনোটিতে একখণ্ড বস্ত্র বেঁধে দেওয়া হয়, তখন দেবী ‘নেকড়াই চণ্ডী’ নামে অভিহিত হন। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে চণ্ডী-অধিষ্ঠিত বৃক্ষের তলায় ঢিল বা ইটের টুকরা দিলেই দেবী ‘ইটাল চণ্ডী’ বা ‘হেঁটাল চণ্ডী’ নামে পরিচিত হন।