বাংলার মাটিতে যেভাবে দুর্গাপূজার গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক সেভাবেই মহালয়াও পালিত হয় ব্যাপক আড়ম্বরে। বাংলায় সবাই মহালয়ার জন্য অপেক্ষা করেন কারণ এখানে দেবী দুর্গাকে কন্যা রূপে মানা হয়। এই দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরি করা হয়, তার চোখ আঁকা হয় এবং প্রতিমাসহ মণ্ডপ সাজানো হয়। দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কারিগররা আগে থেকেই কাজ শুরু করলেও মহালয়ার দিন প্রতিমাকে চূড়ান্ত রূপ দেন। আর এটাই প্রথা হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। মহালয়ার দিনে পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং এই দিন থেকে দেবীপক্ষ শুরু হয়।
মহালয়া ' শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয়। ‘মহালয়া' শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয় ।
সবাই নিশ্চিত মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গোনা, মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমি।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য । আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে শারদীয় পূজা ও দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।
দুর্গাদেবীর আগমনী সংগীত-‘মহালয়া’
সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের জন্য, সঙ্গে পুরো জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, অঞ্জলি প্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন।
সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষের (অমাবস্যা) শেষদিন এটি এবং দেবীপক্ষের (পূর্ণিমা) সূচনা।
পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালয়া। এমনটিও বলা হয়ে থাকে যে, পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি - তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে 'মহালয়ার ' বার্তা বহন করে আনে। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্ন টির নাম মহালয়া। মহালয়ার মধ্য দিয়েই দেবীর মর্ত্যে আগমনের সূচনা ঘটে। বিশেষ পূজা আর মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খের ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে আবাহন করা হয়।
মহালয়ার সঙ্গে অবসান হয় কৃষ্ণপক্ষের। এর পর সূচনা হয় দেবীপক্ষের। এরপর শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নয়টি রাত্রিতে দুর্গার নয়টি রূপের পূজা চলে। এই নয়টি রূপের নাম হল- শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী।
অকাল বোধন
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, বর্তমানে আমরা যে দুর্গাপূজা করি, সেটি মূলত ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয় ।
কালিকাপুরাণ অনুসারে, রাবণবধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য রাত্রিকালে দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা।
পুরাণ মতে, সূর্যের উত্তরায়ণ হচ্ছে দেবতাদের দিন। উত্তরায়ণ অর্থ বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ উত্তরে গমন। সূর্যের এই গমনে সময় লাগে ছয় মাস। এই ছয় মাস দেবতাদের একদিনের সমান। দিনের বেলায় জাগ্রত থাকেন দেবতারা। তাই দিনেই দেবতাদের পূজা করা শাস্ত্রের বিধান। অন্যদিকে সূর্যের দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত। দক্ষিণায়ন অর্থ বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ দক্ষিণে গমন। সূর্যের এই গমনকালের ব্যাপ্তি ছয় মাস। দক্ষিণায়নের ছয় মাস দেবতাদের এক রাতের সমান। স্বাভাবিকভাবেই এই সময় দেবতারা ঘুমান। সেকারণেই রাতে পূজার বিধান নেই শাস্ত্রে। শরৎকাল দক্ষিণায়নের সময়। দেবতাদের রাত্রিকাল। তাই শরৎকাল পূজার্চনার উপযুক্ত কাল নয় - ‘অকাল’। অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাঁকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিই হলো ‘বোধন’।
এই অকালে শ্রীরামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণ রাজাকে পরাজিত করতে শক্তি সঞ্চারে মায়ের পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে অকালবোধন আবার উক্ত সময়টি শরৎকাল বিধায় শারদীয়া পূজা বলা হয়ে থাকে।
দানবীর কর্ণ ও মহালয়া
দানবহাভারতের আখ্যান মতে, কর্ণ কুন্তী পুত্র হয়েও নিয়তির খেলাতে নিজের অজ্ঞাতেই তিনি দুর্যোধনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুতে পরিণত হন। বীরত্বের পাশাপাশি তিনি দাতা হিসেবে অদ্বিতীয় হয়ে ওঠেন। তার কাছে কিছু চেয়ে বিমুখ হয়নি কখনো কেউ। সোনা-দানা, মণিমাণিক্য যে যা চেয়েছে তাই দিয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা অভেদ্য কবচকুণ্ডলও তিনি অবলীলায় হাসিমুখে দান করেছেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণ নিহত হন। তবে পুণ্যময় কাজের পরিণামে স্থান পান স্বর্গে। নরলোকে যে পরিমাণ সম্পদ তিনি দান করেছিলেন তার সহস্রগুণ ফিরে আসে তাঁর কাছে। স্বর্ণ-সম্পদের বিপুল বৈভবের নিচে তিনি যেন চাপা পড়ে যান। তবুও দুঃখী তিনি। সব পাচ্ছেন তিনি কিন্তু পাচ্ছেন না খাদ্য। এই যন্ত্রণা তাকে অস্থির করে তোলে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর কর্ণ যান যমরাজের কাছে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলেন, এ কেমন বিচার!
অফুরন্ত স্বর্ণ রত্ন তিনি পাচ্ছেন, কিন্তু সেসব তো খাদ্য নয়। ক্ষুধার অন্ন নয়। কাজেই সোনাদানার তাঁর দরকার নেই। দরকার খাদ্য।
কর্ণের এই জিজ্ঞাসার মুখে যমরাজ কিছুটা বিব্রত কণ্ঠেই বলেন, এর আমি কী করব? নরলোকে মানুষ যা দান করে, পরলোকে এসে তাই কয়েক সহস্রগুণ ফিরে পান।
কর্ণ কুণ্ঠিত ভাবেই বলেন, আমি তো মর্ত্যে দানে কোনো ত্রুটি রাখিনি। আমার সব ধনসম্পদ আমি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছি। তাহলে কেন বঞ্চিত থাকব খাদ্য-পানীয় থেকে?
যমরাজ বলেন, তুমি ধনসম্পদ দান করেছ, এটা সত্য। কিন্তু তুমি কোনো দিন কাউকে অন্নদান করোনি। দাওনি কোনো তৃষ্ণার্তকে জল। সে কারণে এখানে বঞ্চিত তুমি সেসব থেকে।
-কিন্তু আমি যে ক্ষুধায় অস্থির। এর একটা বিহিত করুন আপনি। ফিরিয়ে নিন সম্পদ, পরিবর্তে দিন একটু খাদ্য। একটু জল।
যমরাজ বলেন, আমি নিরুপায়। ঈশ্বরের বিধান বদলের কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
-না জেনে অপরাধ করেছি। অন্ন-জল দান যে এত মহত্তোম দান, এটা জানা ছিল না। সেই অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করুন। একটা কিছু প্রতিবিধান করুন।
কর্ণের প্রতি যমরাজ সদয় হন। বলেন, বেশ একটা সুযোগ তোমাকে দিচ্ছি। তুমি এক পক্ষের জন্য মর্ত্যলোকে ফিরে যাও। যথেচ্ছ দান কর অন্ন-জল।
এরপর পনেরো দিনের জন্য কর্ণ ফিরে আসেন মর্ত্যে। এই পনেরো দিন তিনি অকাতরে দান করেন অন্ন-জল। পরিণামে স্বর্গে ফিরে পান অন্ন-জল।
আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পনেরো দিন কর্ণের ছিল দ্বিতীয় দফার মর্ত্য বাস। আর এই পনেরটি দিনই হিন্দু শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত। কর্ণ স্বর্গ ফিরে আসেন যে অমাবস্যা তিথিতে- সেটিই অভিহিত মহালয় বা মহালয়া নামে।
তবে শাস্ত্রবিশেষজ্ঞরা বলেন, পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকোজ্জ্বল দেবীপক্ষে আগমন করি, তাই সেই মহা-লগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়া’। এ ক্ষেত্রে দেবী দুর্গা কেই সেই মহান আশ্রয় বলা হয়ে থাকে এবং আঁধার থেকে আলোকে উত্তরণের লগ্ন টিকে বলা হয় মহালয়া।