‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ শারদীয় আহ্বান

শারদীয় দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে অনুষ্ঠিত হয় কুমারীপূজা। গতকাল রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সম্প্রতি গঙ্গা–যমুনা নাট্যোৎসবে কলকাতার অনীক নাট্যদলের একটি নাটক দেখার সুযোগ হলো। নাটকটির নাম ব্রাহ্মণ। বিহার অঞ্চলের একটি দাঙ্গা–বিপর্যস্ত এলাকার কাহিনি।

কাহিনিতে দেখা যায়, একদিন প্রত্যুষে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময় একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ক্ষতবিক্ষত মুমূর্ষু একজন মানুষকে দেখতে পান। আশপাশে অনেক ধার্মিক মানুষ থাকা সত্ত্বেও এই মুমূর্ষু মানুষকে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কেউ না। অবশেষে ব্রাহ্মণ তাঁর বাড়িতে লোকটিকে নিয়ে আসেন। বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্রও ব্রাহ্মণকে বাধা দেয়।

একমাত্র কন্যা ও সেবায়েত তাঁকে সমর্থন দেয়। সবাই ওই মুমূর্ষু লোকটির পরিচয় জানতে চায়। তাঁর শারীরিক অবস্থার চেয়ে ধর্ম ও বর্ণই মুখ্য হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যেই এলাকার রাজনীতিক, সামাজিক নেতারাও বিষয়টি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। তাঁদের সন্দেহ, ওই মুমূর্ষু লোকটি ভিন্ন ধর্মের। তাই তাঁকে এখান থেকে নিয়ে কোনো একটা ঝোপজঙ্গলে ফেলে দিতে হবে।

ব্রাহ্মণ পণ্ডিত অনড়। ধর্মের মানবিক দিকটিই বারবার তিনি তুলে ধরতে চান। তবে পণ্ডিতের বাড়িটি আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথ ধরে তারা ওই বাড়ি থেকে জোর করে মুমূর্ষু মানুষটিকে নিয়ে যায়।

অসহায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত প্রত্যুষে বরাবরের মতো গঙ্গাস্নানে যান এবং ফিরে আসেন না। সম্ভবত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মুসলিম সমাজকেই বেছে নেন। রাজনীতিকেরা এই অন্যায়ের সুযোগ নেন। গঙ্গার ঘাটেই ওই ব্রাহ্মণের নামে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। কিন্তু নিচে লেখা থাকে ‘শুধু হিন্দুদের জন্য’। একসময় ব্রাহ্মণের পরিবার ও উপস্থিত জনগণ স্মৃতিফলকটিকে ভেঙে ফেলে।

বিখ্যাত সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতের একটি ছোটগল্পকে রজত ঘোষ নাট্যরূপ এবং অরূপ রায় নির্দেশনা দিয়ে একেবারেই সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের পরিস্থিতিতে নাটকটি প্রযোজনা করেছেন।

সাম্প্রদায়িকতা গণমানুষের সৃষ্টি নয়। জাতপাত, ধর্ম—এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষ কখনো থাকে না। শত শত বছর ধরে সব ধর্মের মানুষই এই দেশে সহাবস্থান করেছে।

মসজিদ, মন্দির, গির্জা, বৌদ্ধমন্দির পাশাপাশি থেকে যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। এক মাস রোজা রেখে যেমন ঈদ উৎসবে মুসলিম জনগোষ্ঠী আনন্দ
উৎসবে মেতে ওঠে, তেমনি দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজায়, নানা পার্বণে তারা তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকে। ক্রিসমাসে বা বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মাবলম্বী মানুষেরা একটা নতুন জীবনের আবাহনের সঙ্গে যুক্ত হয়।

উৎসব আসলে মানবজাতির একটা সাংস্কৃতিক উদ্‌যাপন। নতুন বস্ত্র, উন্নত খাদ্য, সৌভ্রাতৃত্ব, গুরুজনকে সম্মান, সর্বোপরি মানবজাতির কল্যাণ কামনার একটা উপায়।

ব্রাহ্মণ যেমন মানবতার বাণী প্রচার করছেন, তেমন সুফি–সাধকেরাও যুগ যুগ ধরে এই একটি বাণী মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে রাষ্ট্রের অংশীদারত্বের দাবিদার হয়েই সমস্যাটা জটিল হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহ, ধর্মের নামে শোষণ চালু হয়েছে। বর্ণের ভিত্তিতে সমাজ শাসনের প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সমাজ। আর নানা সময়ে ধর্মীয় উসকানির দাঙ্গা কিছু মানুষের আগ্রাসী সম্পদলিপ্সাকে সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় উসকানিদাতাদের মৃত্যু হয়নি। তারা ঘাপটি মেরে থেকে চেষ্টা করেছে এবং সুযোগ পেয়েই এই ভয়ংকর অস্ত্রটিকে ব্যবহার করেছে। তাই এ দেশের অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিভিন্ন পূজা–পার্বণে সতর্ক থাকতে হয়েছে। এ সময় পূজার প্যান্ডেলগুলোয় পুলিশ মোতায়েন করতে হচ্ছে।

আমাদের বাল্যকাল, কৈশোর, এমনকি আরও পরে কোনো দিন তো রাষ্ট্রীয় পাহারা প্রয়োজন হয়নি। কারণ, প্রকৃত ধার্মিকেরা জানেন, সব ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ, এক মহৎ মানবিক উদ্যোগ।

এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নয়। একটা বড় কারণ হচ্ছে কৃষককুলের অর্থনীতি দুই ধর্মের মানুষের সমবায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সংঘাতের ফলে এই অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। নোয়াখালীর দাঙ্গায় হিন্দু–মুসলমান কোনো দিন অংশ নিত না যদি সেখানকার মোক্তার গোলাম সরোয়ার তাঁর বন্ধুপ্রতিম উকিল রাজেন্দ্র লাল চৌধুরীর জমিদারি প্রাসাদ আক্রমণ না করতেন।

কলকাতার দাঙ্গার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হামলায় ওই বাড়ির প্রত্যেক পুরুষ নিহত হন আর মুসলমানদের আশ্রয়ে মেয়েরা বেঁচে যান। এই গোলাম সরোয়ার সে সময় জেলেও গিয়েছিলেন। তবে তার ‘যোগ্য পুরস্কার’ হিসেবে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যও হয়েছিলেন।

প্রাসঙ্গিকভাবে এসব কথা এসে গেল। উৎসবে এ আকাঙ্ক্ষিত নয়। তবে প্রায়ই আমি পূজায় বিভিন্ন সমাবেশে যাই বলেই কথাগুলো বলছি। কোথাও আমি কোনো রকম দাঙ্গা বাধানোর উদ্যোগ দেখিনি। বরং এই আন্দোলনে সব ধর্মের মানুষ মিলেই অংশগ্রহণ করে। তবে কোথাও কোনো একটি অত্যন্ত সম্পদলোভী গোষ্ঠী ঘাপটি মেরে থেকে সুযোগের সন্ধান করে। সাম্প্রতিক কালে ডিজিটাল ব্যবস্থা তাদের এই সুযোগ সন্ধানে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক কালের বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ থেকে যা কিছু হয়ে আসছে, সবই ওই ফেসবুকের ‘কল্যাণে’।

উৎসব মানুষকে উদার করে তোলে। উৎসব ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবার কাছে আসার একটা সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে শত শত বছর ধরে শরতের আগমনে শারদীয় পূজা বাঙালির ধর্মীয় উৎসব আর থাকে না। যেমন ঈদ, ক্রিসমাস, বুদ্ধপূর্ণিমা এবং সবচেয়ে বড় উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে পয়লা বৈশাখ। মানুষের যেমন ঘরে ঘরে আনন্দ নামে, তেমনি জনতার ঢল নামে পথে, মেলায় সাংস্কৃতিক আয়োজনে। মানুষের যে মানবিক চেতনা, তাকে সমুন্নত রাখাই সব ধর্মের কাজ।

কিন্তু পৃথিবী ক্রমাগত বিভাজনের পথে এগোচ্ছে। এই বিভাজনের প্রক্রিয়ায় ধর্মও বাদ যায়নি। লেখার প্রথমে যে ব্রাহ্মণের কথা উল্লেখ করেছি, সব ব্রাহ্মণই ও রকম নন। কাজী নজরুল মোল্লা–পুরোহিতদের বিষয়ে স্পষ্টই উচ্চারণ করেছেন। ধর্মযুদ্ধের নামে মানুষ নিধন হয়েছে; দাঙ্গায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ–বৃদ্ধার অসহায় মৃত্যুবরণ আমরা দেখেছি, যার মধ্য দিয়ে মানবজাতি কলঙ্কিত হয়েছে।

এসব আর কাম্য নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তির পক্ষে। মানবজাতি একটি উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী। কিন্তু সেই মানুষই কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ কখনো কখনো ডেকে এনেছে। এসবের বিনাশ হোক। এক অবিনাশী কল্যাণকর শারদীয় উৎসবের মধ্যে উচ্চারিত হোক ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব