বাঙালির একটি পার্বণ হলো বাসন্তীপূজা। সাধারণত চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের বাসন্তীপূজা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আদি দুর্গাপূজা। শরৎকালে দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপুজা, আর বসন্তকালে দেবীর আরাধনা বাসন্তীপূজা হিসেবেই প্রসিদ্ধ। শারদীয়া দুর্গাপূজা আর বাসন্তীপূজা, উভয় পূজার রীতি প্রায় এক। বাসন্তীপূজা অবাঙালিদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। তবে বাঙালিরা শারদীয় দুর্গাপূজাকেই প্রধান পার্বণ হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সাহিত্যিক রাধারমণ রায় লিখেছেন, ‘সেনযুগে দুর্গাপূজা পরিণত হয় রাজ-রাজড়া আর দস্যু-তস্করের পূজায়। রাজ-রাজড়ারা এই পূজা করতেন বছরের শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তকালে। যখন প্রকৃতি ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠত, তখন গরিব প্রজাদের কাছ থেকে খাজনার নামে ছিনিয়ে আনা রক্তরাঙা টাকায় রাজা-জমিদাররা দুর্গাপূজা করতেন জৌলুস-জাহিরের জন্যে। তখন এই পূজার নাম ছিল বাসন্তী।’
আকবরের রাজত্বকালেই ১৫৮০ সাল নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেন বলে জানা যায়। তা হলে কংসনারায়ণের পূর্বে শারদীয়া দুর্গাপূজার অস্তিত্ব কি ছিল না? রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এ দেশে বসন্তকালে হত দুর্গাপূজা আর শরৎকালে হতো নবপত্রিকা পূজা, যার স্থান আজ গণেশের পাশে। নবপত্রিকাই কালক্রমে চার পুত্র-কন্যাসহ দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে রূপান্তরিত।
শাস্ত্রীয় বিশ্বাস মতে, যে সময়টা উত্তরায়ণ, অর্থাৎ দেবতারা জেগে থাকেন, সেই সময়েই বাসন্তী পূজার নির্ঘণ্ট। তাই বাসন্তী পূজায় দেবীর অকালবোধনের উপাচার নেই। আবার শীতের পরে বসন্তের অতি মনোরম, ঝড়-ঝঞ্ঝামুক্ত আবহাওয়াতেই এই পূজার ব্যবস্থা হয়েছিল। শরৎকালে কিন্তু আবহাওয়া সর্বদা অনুকূল থাকে না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপে উৎসবে তৈরি হয় বিঘ্ন। তা ছাড়া এই সময়টা দক্ষিণায়ন, দেবতারা নিদ্রিত। ফলে প্রয়োজন অকাল বোধনের।
পুরাণমতে রাজা সুরথ করেন বাসন্তীপূজা এবং রাবণ বধের আগে রামচন্দ্র করেন শারদীয়া দুর্গাপূজা। তবে বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হয় শারদীয় দুর্গাপূজা।
শারদীয়া দুর্গাপূজার গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে মোগল আমলে রাজস্ব প্রদানের নতুন নিয়মেরও ভূমিকা আছে। নতুন নিয়মে দিল্লিতে মোগল সম্রাটের কাছে প্রাদেশিক শাসনকর্তা, অর্থাৎ নবাবকে ভাদ্র মাসের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব পাঠানোর নির্দেশ জারি হয়। অর্থাৎ স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের তার আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা জমা দিতে হত। এই নির্দিষ্ট খাজনা বাদ দিয়ে রাজস্বের বাকি অংশ ছিল স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের প্রাপ্য। তাই সঞ্চিত রাজস্বের অনুষঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে শরতের এই সময়টি ছিল বসন্তের তুলনায় উৎসব উদ্যাপনের উপযুক্ততর সময়। অতএব হিন্দু রাজা-জমিদারদের একটা বড় অংশ নিজেদের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রতি সমর্থন দেওয়া শুরু করেন। আবার এই মোগল রাজস্ব ব্যবস্থার হাত ধরেই যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল। তার সূত্রে কৃষ্ণনগরসহ বেশ কিছু নগরভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটে। মধ্যযুগের বাংলায় এই সব হিন্দু অধিপতিরা, নদীকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার ‘গ্রামীণ’ বাসন্তীপূজার তুলনায় শারদীয়া দুর্গার প্রতিই পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন। প্রসঙ্গত অষ্টাদশ শতকের হিন্দু নেতৃস্থানীয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা স্মরণ করতেই হয়। শাক্ত ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করতে গিয়ে তিনি তন্ত্রমতে দেবী অন্নপূর্ণার যে পূজা করেছিলেন, তার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় বাসন্তী পূজার অষ্টমী তিথিতে। এর ফলে রাজার পৃষ্ঠপোষিত অন্নপূর্ণাই প্রধান হয়ে ওঠেন, গুরুত্ব নষ্ট হয় প্রাচীন বাসন্তী দুর্গার।
অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য সব কালেই মানুষ আদ্যাশক্তির আরাধনা করে। পুরাণ অনুযায়ী, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে রাজ্য-হারানো রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে মূর্তি গড়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন, যা পরে বাসন্তী পূজা নামে প্রসিদ্ধ হয়। সেটাই চলতে থাকে। কিন্তু রামচন্দ্র সীতা-উদ্ধার কালে অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য শরৎকালেই দুর্গার আরাধনা করলেন। এটি অকালবোধন হিসাবে বিখ্যাত হল। আর তার পর থেকে এই পূজাই চলতে থাকল।
বাল্মীকি অকালবোধনের ঘটনাটি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর বঙ্গ-রামায়ণে এই অংশের এমন আবেগমথিত বর্ণনা দেন যে, তা বরাবরের জন্য বাঙালিচিত্তে গেঁথে যায়। শরৎকালের দুর্গাপূজা এইভাবেই ধীরে ধীরে তার নিজস্ব ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান রচনা করে জনমনে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে।
তবু বাঙালি তার আদি দুর্গাপূজাকে কোনোদিনই পুরোপুরি ভুলে যায়নি। সে এখনও দুর্গাপূজার আদিরূপ বাসন্তীপূজার আয়োজন করে। যদিও এই পূজা কোনো দিনই বারোয়ারির আকার নেয়নি। রাজ-রাজরা জমিদারদের আঙ্গিনা ছেড়ে এই পূজা কোনো দিনই সাধারণের পূজা হয়ে ওঠেনি।
তবে কেউ কেউ বাসন্তী পূজার ভিন্ন কারণের কথাও বলেন। বসন্তঋতুর শেষে গ্রীষ্মের শুরুর এই সময়টায় সেকালে বসন্ত রোগের খুব প্রকোপ ছিল। টিকাহীন চিকিৎসাহীন সেই অতীতে দুর্বার বসন্তের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য মায়ের আরাধনা করে তার কৃপা প্রার্থনা করা হত। রোগকে প্রশমিত করার জন্য়ও তাই বাসন্তীদেবীর পূজার চল হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
লোককাহিনিমতে, আগের দিনে রাজারা যুদ্ধে পরাজিত না হওয়ার জন্য শক্তির উপাসনা করতেন। সেই হিসেবে মহামায়াকে অপার শক্তির সাথে তুলনা করা হয়। আর মনে করা হয়, তার আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলে কোনো কাজেই পরাজয় আসবে না। পৌরাণিক কাহিনি মতে, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী মহামায়া তথা দুর্গার আরাধনা করেন। যা পরে বাসন্তীপূজা নামে প্রসিদ্ধ হয়। দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসাবে চণ্ডীতে রাজা সুরথের উল্লেখ রয়েছে।
মানুষ আসলে শক্তির উপাসক। একসময় সেই শক্তি ছিল বিভিন্ন দেবদেবী। এখন যে আসন দখল করেছেন বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীরা। তাদের মন জয় করতে পারলেই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। সমস্ত ঐশ্বর্য হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়।
চিররঞ্জন সরকার: কলাম লেখক