পূজার অর্থ, পূজার মাহাত্ম্য

কেউ কেউ বলেন, আমরা যে পূজা করি, তার উদ্দেশ্য আরাধ্য দেবতা বা দেবীকে প্রসন্ন করে পার্থিব জগতে সমৃদ্ধি লাভ করা। তাঁরা আরও বলেন, পূজা যেন দোকানদারি—আমি তোমাকে দিচ্ছি, বিনিময়ে তুমি আমাকে দাও। পূজা যেন এই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার। 

এমনকি এ কথাও বলতে শোনা যায়, পূজা আর কিছুই নয়—দেবতাকে উৎকোচ প্রদান। পূজা-উপচারে দেবতা খুশি হবেন, তখন তাঁর কাছ থেকে অভীষ্ট বস্তু লাভ হবে, মামলায় জয়লাভ হবে, পুত্র-কন্যার পরীক্ষায় সাফল্য লাভ হবে, বেকার থাকলে চাকরি হবে, ব্যাধিগ্রস্ত প্রিয়জন ব্যাধিমুক্ত হবে, মুমূর্ষু প্রিয়জন মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে আসবে ইত্যাদি। 

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, দেবতার উদ্দেশে আমরা যে স্তবগান করি, যে প্রার্থনা উচ্চারণ করি, তা তো শুধু ‘দেহি’ ‘দেহি’রই দীর্ঘ তালিকা: 

‘ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্তানুসারিণীম। 

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।’ (চণ্ডী) 

(হে দেবী, আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী, অর্থাৎ আমার প্রতি একান্ত অনুরাগিণী সুন্দরী ভার্যা দাও। আমাকে রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও এবং আমার প্রতি যারা বিদ্বেষপূর্ণ, অর্থাৎ যারা আমার শত্রু, তাদের নাশ করো।) 

সাধারণভাবে এখন পূজার তাৎপর্য প্রায় এটাই দাঁড়িয়েছে, আপাতদৃষ্টে দেবতার উদ্দেশে স্তবস্তোত্রাদি বাচ্যার্থে এটাই বোঝায়।

পূজা সান্ত মানুষকে অনন্তে উত্তরণ করানোর একটি পদ্ধতি। পূজার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমাদের প্রাজ্ঞ পূর্বপুরুষেরা অনন্তে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে প্রয়াস পেয়েছিলেন।

সাধারণ মানুষও যাতে উত্তরণের এই ‘বিজ্ঞান’-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়, সে জন্য তাঁরা পূজার অনুষ্ঠানাদির মধ্যে একটি আপাত ও লোকপ্রিয় রূপ সংযুক্ত করেছিলেন। 

সাধারণ মানুষ প্রথমেই উচ্চ দর্শনকে গ্রহণ করতে পারে না, তাদের সেই মানসিক প্রস্তুতিও থাকে না।

পূজার মধ্যে সন্নিবিষ্ট ‘শুদ্ধি’, ‘ন্যাস’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের যে একটি লোকপ্রিয় আবেদন আছে, তা অনস্বীকার্য। আবার পূজার সঙ্গে যুক্ত স্তবস্তোত্রাদির মধ্যে যে পার্থিব প্রাপ্তির অঙ্গীকার রয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে সহজেই আকর্ষণ করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ‘এহ বাহ্য’ এই অনুষ্ঠানাদি ও প্রার্থনার দুটি তাৎপর্য রয়েছে। একটি বাচ্যার্থ, অপরটি লক্ষ্যার্থ। 

‘রূপং দেহি’ ইত্যাদিতে ‘রূপ’ প্রভৃতি প্রতিটি শব্দের একটি আপাত–অর্থ আছে, আবার একটি মর্মার্থ বা নিগূঢ় অর্থও রয়েছে। ‘রূপ’ মানে যেমন বাহ্য সৌন্দর্য, তেমনি অন্তরের সৌন্দর্যও। ‘জয়’ মানে যেমন জীবনসংগ্রামে জয়লাভ, তেমনি অন্তরের সংগ্রামেও, অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মানসসংগ্রামেও জয়লাভ। 

 ‘ভার্যা’ মানে যেমন স্ত্রী, তেমনি আবার যা ভরণীয়—অন্তরে একান্ত লালনীয়, অর্থাৎ ভক্তি, অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি অব্যভিচারিণী অনুরক্তি। ‘শুদ্ধি’, ‘ন্যাস’ প্রভৃতি পূজার বিভিন্ন অঙ্গ সম্পর্কেও একই কথা। 

 ‘শুদ্ধি’র অর্থ শুদ্ধিকরণ এবং ‘ন্যাস’-এর অর্থ স্থাপন বা সমর্পণ। প্রথমে ‘শুদ্ধি’, তারপর ‘ন্যাস’। প্রথমে আচমনাদির দ্বারা পূজকের ‘দেহশুদ্ধি’ করতে হয়। পূজক প্রথমে নানা অশুদ্ধ উপাদান ও পদার্থে নির্মিত ও পূর্ণ তাঁর দেহভাণ্ডটিকে মন্ত্রপূত জল দ্বারা শুদ্ধ করেন।‘দেহশুদ্ধি’র সময় তিনি ভাবেন, তাঁর দেহ সমস্ত মালিন্যরহিত হয়ে উঠছে, তাঁর মন অশুদ্ধ চিন্তারাশি থেকে মুক্ত হয়ে উঠছে এবং তাঁর আত্মা দেবময় হয়ে যাচ্ছে।

এভাবে ‘বাহ্য-অভ্যন্তর’ বা দেহ-মন-আত্মার শুদ্ধিকরণের পর ‘জলশুদ্ধি’। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী—এই সপ্তনদী হিন্দু ঐতিহ্যে পবিত্রতম নদী বলে প্রসিদ্ধ। নদীমাতৃক ভারতবর্ষে এই নদীগুলো শুধু পবিত্রই নয়, এরা দেবী হিসেবেও বন্দিত, আবার জননীরূপেও পূজিত। 

‘জলশুদ্ধি’র সময় পূজক যে অপূর্ব মন্ত্রটি উচ্চারণ করেন, উদাহরণস্বরূপ এখানে তা উল্লেখ করা যেতে পারে:

‘ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী। 

নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু।’ 

(হে নদীতমা, দেবীতমা, অম্বিতমা গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী, তোমরা এই জলপাত্রে অধিষ্ঠান করো) 

এই আহ্বানের দ্বারা পূজার জলপূর্ণ পাত্রটি যেন পবিত্রতম সপ্তনদীর ক্ষুদ্র সঙ্গমে পরিণত হয়। এরপর সেই পবিত্র জল পূজার সব উপকরণ ও উপচারে সিঞ্চন করে তাদের পরিশুদ্ধ করে নেওয়া হয়।

জলশুদ্ধির মন্ত্রটি আরেক দিক দিয়েও লক্ষণীয়। এই মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের জাতীয় সংহতির উদার উপলব্ধি। 

অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এই সাত নদী প্রবাহিত। সাংস্কৃতিক প্রেরণা ও ভাবের দিক থেকে হাজার বছর ধরে এই সপ্তনদী ভারতবর্ষকে এক অপূর্ব ঐক্যের প্রেরণামন্ত্রে সংবদ্ধ করে রেখেছে। 

বস্তুত, সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রেরণাই ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্যবোধকে সঞ্জীবিত করে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শুধু যে পূজার অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে নিজ দেহকে দেবময় করতে চেয়েছিলেন তা নয় আমাদের মাতৃভূমির ভৌগোলিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দেহকেও তাঁরা দেবময় বলে ভেবেছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আমাদের পূর্বপুরুষের কাছে ভারতবর্ষ শুধু মাতৃভূমিই ছিল না, ভারতবর্ষকে তাঁরা দেখেছেন পুণ্যভূমিরূপে, দেবাত্মভূমিরূপে। 

এভাবে ভারতবর্ষ তাঁদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে একটি আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে।

পূজার অন্য অনুষ্ঠানাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ন্যাস’। জীবন্যাস, মাতৃকান্যাস, করন্যাস, অঙ্গন্যাস ইত্যাদির মাধ্যমে পূজকের দেহের প্রতিটি অঙ্গে পঞ্চাশৎ বর্ণের মাধ্যমে পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী মাতৃশক্তিকে ‘ন্যাস’, অর্থাৎ স্থাপন করা হয়। 

জীব আসলে ব্রহ্মই, অজ্ঞানতাবশত জীব জানে না যে সে ব্রহ্ম। ‘জীব শিব’—এই অদ্ভুত সমীকরণ পৃথিবীকে ভারতবর্ষই প্রথম উপহার দিয়েছে। বর্তমানে ধর্ম যেমন নানা মহলে সমালোচিত ও নিন্দিত, তেমনি পূজাদির মতো অনুষ্ঠানাদিও তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত মহলে উপহাসিত। এরা আমাদের ঐতিহ্যের মূল্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে কিছুমাত্র অবহিত না হয়ে আমাদের ঐতিহ্যকে, আমাদের ধর্মকে, আমাদের আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানকে আক্রমণ করে। সত্য বটে, কালের গতিতে আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের ধর্মে, আমাদের আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানাদিতে নানা বিকৃতি এসে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু তাই বলে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ধর্ম, আমাদের আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানাদি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেনি। প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টির, প্রয়োজন মুক্ত মন, উদার বোধ ও সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির, যাতে আমরা বুঝব আমাদের পূর্বপুরুষেরা কত বড় বিজ্ঞানদৃষ্টির, কত গভীর প্রজ্ঞা ও লোকদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। বস্তুত আজ তাঁদেরই সৃষ্ট ভিত্তিভূমিতেই নিহিত ভারতবর্ষ নামের দেশটির মূল প্রাণরস। সেই আদি প্রাণরস থেকেই উদ্ভূত ভারতবর্ষের সব গৌরব, সব মহিমা। ভারতবর্ষ যে স্থূল থেকে সূক্ষ্মের দিকে তার অধিবাসীদের চেতনাকে অগ্রসর করাতে চেয়েছে, জড়ের শক্তিকে অস্বীকার করে চৈতন্যের শক্তিকে আবিষ্কার করতে সর্বতোভাবে প্রণোদিত করেছে, ভূলোকের ধূলিকে ঝেড়ে ফেলে দ্যুলোকের সৌরভকে অঙ্গে মাখতে অনুপ্রাণিত করেছে, পূজাবিজ্ঞানের কিছু অনুষ্ঠানের আলোচনার মাধ্যমে তা আমরা দেখাতে চেষ্টা করেছি। বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়ের পরিসমাপ্তি একত্বের আবিষ্কারে, একত্বের উপলব্ধিতে। পূজার মতো একটি লোকপ্রিয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দুর ধর্ম সেই একত্বকে, সেই অদ্বৈতকেই আবিষ্কার করতে, উপলব্ধি করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। পূজাবিজ্ঞানের এই তত্ত্ব আমাদের সবারই জানা একান্ত প্রয়োজন।

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, অধ্যক্ষ ও সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা