প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনি অবলম্বনে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক। বাল্মীকি রচিত পৃথিবীর আদি মহাকাব্য। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবনকাহিনি এর মূল উপজীব্য।
রামায়ণ সপ্তকাণ্ডে বিভক্ত। (১) আদিকাণ্ডে রামের জন্ম ও বাল্যজীবন; (২) অযোধ্যাকাণ্ডে অযোধ্যা থেকে রামের বন-নির্বাসন; (৩) অরণ্যকাণ্ডে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার বনবাস ও রাবণ কর্তৃক সীতা-হরণ; (৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব; (৫) সুন্দরকাণ্ডে রামের সসৈন্যে লঙ্কায় উপস্থিতি; (৬) লঙ্কাকাণ্ডে রাম-রাবণের যুদ্ধ; রাবণের সবংশে মৃত্যু ও রাম কর্তৃক সীতার উদ্ধার ও সদলবলে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন; (৭) উত্তরকাণ্ডে রাজা রাম কর্তৃক সীতার বনবাস, লব-কুশের জন্ম, রাম ও সীতার পুনর্মিলন এবং মৃত্যু। আদি ও উত্তরকাণ্ড পরবর্তীকালে সংযোজিত বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই মহাকাব্যের শ্লোকসংখ্যা বিভিন্ন ভাষ্য অনুসারে ২৪ হাজার থেকে ৪৩ হাজারের মধ্যে। কৃত্তিবাস ওঝা এর বাংলা অনুবাদ করেন। অনুবাদ থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে পরিচিত। হিন্দি তুলসীদাসী রামায়ণ (রামচরিত মানস) উত্তর ভারতে বহুল প্রচলিত।
রামায়ণ কাহিনি অযোধ্যার রাজা দশরথের তিন মহিষীর গর্ভে চার পুত্র জন্মে। প্রথমা পত্নীর গর্ভে রাম, দ্বিতীয়া পত্নীর গর্ভে ভরত ও তৃতীয়া পত্নীর গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নর জন্ম। জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম বিশ্বামিত্র মুনির আমন্ত্রণে তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করেন। বিশ্বামিত্র রামকে রাজা জনকের সভায় নিয়ে যান এবং সেখানে রাম শিবের ধনুকে জ্যা পরিয়ে ধনুকটি ভেঙে ফেলেন। রামের বীরত্বে মুগ্ধ জনক রাজা তাঁর সঙ্গে নিজের কন্যা সীতার বিয়ে দেন। জনকের ভ্রাতুষ্পুত্রীদের সঙ্গে রামের তিন ভাইয়েরও বিয়ে হয়। দশরথ রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে উদ্যোগী হলে তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী কৈকেয়ী তাতে বাধা দেন। একবার কৈকেয়ী স্বামীকে সন্তুষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে ‘ইচ্ছাবর’ লাভ করেছিলেন। সেই কথা স্মরণ করিয়ে তিনি দশরথকে বলেন রামকে বনবাসে পাঠিয়ে নিজের পুত্র ভরতকে রাজা করতে।
দশরথ প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে পাঠান। রামের সঙ্গী হলেন তাঁর পত্নী সীতা ও পরমভক্ত অনুজ লক্ষ্মণ। দশরথ মনের দুঃখে প্রাণত্যাগ করেন। ভরত তখন অন্যখানে ছিলেন। তিনি অযোধ্যায় ফিরে রামকে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করতে ও রাজা হতে অনুরোধ করেন। রাম রাজি না হওয়ায় ভরত রামের প্রতিনিধিস্বরূপ রাজ্য শাসন করতে থাকেন। সীতা ও লক্ষ্মণসহ রাম দণ্ডকারণ্যে বনবাসের জীবন আনন্দে কাটাচ্ছিলেন। লঙ্কারাজ রাবণের বোন রাক্ষসী শূর্পণখার অভিসারমূলক উৎপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লক্ষ্মণ তাঁকে তাড়িয়ে দেন।
শূর্পণখা রাবণকে সীতাহরণে প্ররোচিত করেন। রাবণ ছলনা করে সীতাকে একাকিনী পেয়ে হরণ করেন। সীতাহারা রাম নানা জায়গায় ঘুরে কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন। সেখানে বানর রাজ্যের দুই রাজপুত্র বালী ও সুগ্রীবের মধ্যে বিবাদ ছিল। রাম সুগ্রীবের পক্ষ নিয়ে তাঁর অগ্রজ বালীকে বধ করেন। সুগ্রীব রাজা হয়ে বানর সেনাদের নিয়ে রামের সাহাঘ্যে অগ্রসর হন। রাম লঙ্কায় গিয়ে রাবণ, তাঁর পুত্র ও ভাইদের বধ করেন। বানরদের মধ্যে রামের পরম ভক্ত হনুমান লঙ্কা থেকে সীতার খোঁজ নিয়ে আসেন এবং রাবণের ভাই বিভীষণও রামের পক্ষ নেন। রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজা হতে সাহাঘ্য করে নিজ রাজ্যে ফেরেন ও অযোধ্যার রাজা হন। রাবণের হাতে সীতা বহুদিন বন্দিনী থাকায় প্রজাদের মধ্যে একশ্রেণীর লোক সীতার চরিত্রহানি ঘটেছে, এমন সন্দেহ প্রকাশ করে। প্রজানুরঞ্জনে রাম সীতাকে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে নির্বাসন দেন। বাল্মীকির আশ্রমে রামের ঔরসে সীতা দুই যমজ পুত্র কুশ ও লব প্রসব করেন। বাল্মীকি তাঁদের দিয়ে রামায়ণ রচনা করিয়ে গান করাতে থাকেন। রামের অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে কুশ ও লব অযোধ্যায় গিয়ে রামায়ণ গান শোনান। রাম যমজ ভ্রাতৃদ্বয়কে আপন সন্তান বলে বুঝতে পারেন। তিনি তখন পত্নী সীতাকে ফিরিয়ে আনেন। সীতার চরিত্র শুদ্ধির প্রমাণ চাওয়া হলে সীতা মনের দুঃখে ধরিত্রী-গর্ভে অদৃশ্য হয়ে যান। রাম কুশকে অযোধ্যার রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে ভ্রাতৃবর্গ ও পরিজনবর্গসহ তিনি নিজেও সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন করেন।