জন্মাষ্টমী

কৃষ্ণ: পরোপকারী, রাজনীতিজ্ঞ ও প্রেমিক

জন্মাষ্টমী কৃষ্ণের জন্মতিথি। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব। এ উপলক্ষে উপবাস, কৃষ্ণের পূজা, চন্দ্রকে অর্ঘ্যদান ও রাত্রি জাগরণ সেরে রোহিণীব্রত পালন করলে সাত জন্মের পাপমুক্তি ঘটে। শাস্ত্রে আরও কথিত আছে, কোনো সক্ষম পুরুষ বা নারী এ দিন উপবাস না করলে পরজন্মে রাক্ষস বা সর্প হয়ে তাকে বনবাস করতে হবে।

কৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তাঁকে স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর পূর্ণাবতারও মনে করা হয়। গীতায় বলা হয়েছে যে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সজ্জনের রক্ষার জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটে। পৃথিবীর ভারমোচন তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব হলেও একজন মর্তজীবী মানুষ হিসেবে রাজনীতি, সমাজ, সংসার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাঁকে কর্তব্য পালন করতে দেখা যায়।

কৃষ্ণের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ঋগ্‌বেদে একাধিকবার কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি ইন্দ্রবিরোধী একজন অনার্য যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। কোথাও তাঁকে ঋষি, এমনকি অসুরও বলা হয়েছে। ছান্দোগ্যোপনিষৎ এবং কৌষিতকীব্রাহ্মণে কৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়েছে। তাঁর গুরু ছিলেন ঘোর-আঙ্গিরস। কারও কারও মতে, এই কৃষ্ণই পৌরাণিক যুগে বাসুদেব কৃষ্ণে পরিণত হয়েছেন।

মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মামা কংসের কারাগারে ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্ম। এই দিনটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দ্বারা জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়। কৃষ্ণকে কেউ কেউ অনার্য দেবতা বলেও মনে করেন। তাঁদের মতে, আদিম জনগোষ্ঠীর উপাস্য এই দেবতা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। আবার তাঁকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মমত প্রবর্তিত হয়। কৃষ্ণ কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র কি না, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন তাঁর বাস্তব বা মানবীয় অস্তিত্ব ছিল না। আবার কারও কারও মতে, তিনি একজন আদর্শচরিত্র ঐতিহাসিক পুরুষ, ধর্মপ্রবক্তা ও সংস্কারক ছিলেন। কালক্রমে ভক্তরা তাঁকে দেবতা, এমনকি ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করে। তাঁকে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’ বলেও সম্বোধন করা হয়।

কৃষ্ণ চরিত্রটি একই সঙ্গে চমকপ্রদ ও বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনি থেকে তাঁর তিনটি প্রধান রূপ লক্ষ করা যায়: পরোপকারী, প্রেমিক ও রাজনীতিজ্ঞ। শিশুবয়সেই কৃষ্ণের পরোপকারী ভূমিকাটির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম জীবনেই কৃষ্ণ যে কাজগুলো করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কংসবধ। অত্যাচারী কংস ছিলেন মথুরার রাজা। তিনি নিজের পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে আটক রেখে সিংহাসন অধিকার করেন। এমনকি ভবিষ্যদ্বাণীতে কৃষ্ণ তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে জেনে তিনি নিজের বোন-ভগ্নিপতি অর্থাৎ কৃষ্ণের মাতা-পিতা দেবকী ও বসুদেবকেও কারাগারে আটক এবং তাঁদের সন্তানদের হত্যা করেন। কংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য জন্মের পরই পিতা বসুদেব তাঁকে গোকুলে নন্দ-যশোদার ঘরে রেখে আসেন। কংস সে কথা জানতে পেরে গোকুলের সব শিশুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কংসের নির্দেশে পূতনা রাক্ষসী তার বিষাক্ত স্তন্য পান করিয়ে একের পর এক শিশুদের হত্যা করতে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণকে হত্যা করতে গেলে তাঁর হাতে পূতনা রাক্ষসী নিজেই নিহত হয়। এভাবে শিশু কৃষ্ণ গোকুলের শিশুদের রক্ষা করেন। এরপর একে একে তিনি বৎসাসুর, অঘাসুর, বকাসুর প্রভৃতি অপশক্তিকে বিনাশ করেন। এ ছাড়া কালীয়দহে কালীয় নাগ দমন, বৃন্দাবনকে রক্ষার জন্য দাবাগ্নি পান, ইন্দ্রের আক্রোশ থেকে গোপদের রক্ষার জন্য আঙুলে গোবর্ধনগিরি ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি বালক বয়সেই মর্তবাসীর উপকার করেন। কৃষ্ণ মথুরায় এসে কংসকে হত্যা করে কৃষ্ণ তাঁর মাতামহ এবং পিতা-মাতাকে কারাগার থেকে উদ্ধার এবং মথুরায় শান্তি স্থাপন করেন। এভাবে অশুভ শক্তির হাত থেকে শুভ শক্তিকে রক্ষার জন্য কৃষ্ণ পরবর্তীকালে আরও অনেক দুরাচারীকে হত্যা করেন বা করান।

হরিবংশপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্েথ শ্রীকৃষ্ণ একজন প্রেমিক, সখা এবং গোপীজনবল্লভরূপে চিত্রিত হয়েছেন। গোপনারীদের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তার মধ্য দিয়ে ভারতীয় বেদান্তদর্শনের জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনতত্ত্ব প্রচারিত হয়েছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই জীবের প্রধান লক্ষ্য বা চূড়ান্ত কাঙ্ক্ষিত বিষয়, যাকে মোক্ষ বলা হয়। আর কৃষ্ণই হলেন সেই পরমাত্মা। কৃষ্ণের সখাদের মধ্যে প্রধান হলেন অর্জুন, তিনি তাঁর আত্মীয়ও। এ ছাড়া তাঁর সখাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রীদাম, সুদামা, উদ্ধব প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে কৃষ্ণের আচরণ যেকোনো মর্তবাসী মানুষের মতোই।

মহাভারতে কৃষ্ণ একজন রাজনীতিক, যোদ্ধা, কূটনীতিক এবং দার্শনিকরূপে চিত্রিত হয়েছেন। পাণ্ডবদের পক্ষে তিনি দৌত্যক্রিয়া ও তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের পরামর্শ দান ও শেষ পর্যন্ত তাঁদের বিজয়ী করা, দুর্যোধন প্রমুখ দুর্জনদের বিনাশ করে ধর্মকে প্রতিস্থাপন ইত্যাদি কাজ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি নিজে অস্ত্র ধারণ করেননি বটে, তবে পাণ্ডবদের পক্ষে মূলত তিনিই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষাত্রধর্ম এবং আত্মা সম্পর্কে যেসব উপদেশ দিয়েছেন তা ভগবদ্গীতা নামে খ্যাত। দুষ্টের দমন ও অধর্মের বিনাশ করে তিনি জগদ্বাসীর কাছে শিষ্টের পালন ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার নজির স্থাপন করেছেন। আপন যদুবংশে অনাচার দেখা দিলে তা-ও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। কৌশলে যদুবংশ ধ্বংস করেন। শেষে অবশ্য এক ব্যাধের শরাঘাতে তাঁকে ইহলীলা সংবরণ করতে হয়। 

সূত্র: ‘কৃষ্ণ’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪