মহাদেব : পরমেশ্বরের সংহারশক্তিস্বরূপ

মহাদেব শ্রেষ্ঠ তিন দেবতার অন্যতম। তাঁর আরেক নাম শিব। তিনি পরমেশ্বরের সংহারশক্তিস্বরূপ। মহাপুরুষ কতৃর্ক সৃষ্ট হয়ে তিনি তপস্যামগ্ন হন, এবং এ ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে ধারণ করেন যোগী বেশ। ব্যাঘ্রচর্ম তাঁর পরিধেয়, সর্প তাঁর কটিবন্ধ ও উত্তরীয়, ভস্ম তাঁর বিভূতি এবং নন্দী তাঁর পার্শ্বচর। মহামুনি অত্রির তিনি শিষ্য। ঈশ্বরের সংহারমূর্তি বলে তিনি সব ধরনের অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ। ত্রিশূল তাঁর প্রধান আয়ুধ। তাঁর ধনুর নাম পিনাক। যুদ্ধের সময় এটি শরনিক্ষেপ ও অন্য সময়ে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমরে তিনি অজেয়। ত্রিপুরাসুরকে বিনাশ করে তিনি ত্রিপুরারি উপাধিতে ভূষিত হন। বিষ্ণুর সহায়তায় তিনি জলন্ধরকে বধ করেন। এ ছাড়া বাণাসুরকে সাহাঘ্য করার জন্য শোণিতপুরে গেলে সেখানে সংঘটিত যুদ্ধে কৃষ্ণের কাছে তিনি পরাজিত হন।

দেবতাদের সমুদ্রমন্থনকালে তিনি সবার শেষে উপস্থিত হয়ে পুনরায় সমুদ্রমন্থনের ইচ্ছা পোষণ করেন। দ্বিতীয়বার মন্থনে হলাহল উত্থিত হলে তিনি তা পান করে নীলকণ্ঠ নাম ধারণ করেন। তপস্যায় অতি সহজে তুষ্ট হয়ে তিনি ঈপ্সিত বর প্রদান করে থাকেন বলে তাঁর আরেক নাম আশুতোষ। তাঁর বরপ্রভাবে বৃত্র, বাণ প্রমুখ দৈত্য উদ্দীপ্ত হয় এবং অত্যাচারী হয়ে ওঠে। পরে তারা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। পরশুরাম তাঁর কাছেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করে স্বীয় প্রতিজ্ঞা পালনে সমর্থ হন। বিশ্বামিত্রও তাঁর অস্ত্র লাভ করেন। অজুর্নের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে কিরাতবেশে দেখা দেন, এবং ছলে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। পরিশেষে প্রসন্ন হয়ে তিনি অজুর্নকে পাশুপত অস্ত্র প্রদান করেন।

মহাদেব প্রথমত দক্ষরাজতনয়া সতীর পাণিগ্রহণ করেন। একদা ভৃগুর যজ্ঞে তিনি শ্বশুরকে যথোচিত অভিবাদন না করায় দক্ষ কুপিত হয়ে তাঁকে অবমাননা করার অভিপ্রায় নিয়ে শিবহীন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। সতী অনিমন্ত্রিতা হওয়া সত্ত্বেও পিতৃযজ্ঞে গমন করেন। সেখানে সতীকে দেখে দক্ষ অযথা শিবনিন্দায় আত্মরসনা কলুষিত করেন। পতিপরায়ণা সতী পতির নিন্দা শ্রবণে অভিমানে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করেন। এ খবর পেয়ে মহাদেব ক্রোধে স্বীয় জটা ছিন্ন করার পর তা থেকে বীরভদ্রের উৎপত্তি হয়। বীরভদ্র দক্ষালয়ে গমন করে দক্ষের যজ্ঞনাশ ও মুণ্ডচ্ছেদ করেন। পরে মহাদেব সেখানে উপস্থিত হলে শাশুড়ি প্রসূতির অনুরোধে দক্ষকে পুনর্জীবন দান করেন। এরপর সতীর শবদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি উন্মত্তের মতো দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করতে উদ্যত হলে বিষ্ণু স্বীয় চক্রের আঘাতে সেই শবদেহকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেন। তখন মহাদেব মহাযোগে নিমগ্ন হন। এদিকে সতী হিমালয়ের গৃহে পার্বতী নাম ধারণ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে মহাদেবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞ হন। মদন মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করতে গিয়ে তাঁর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যান। পার্বতী নিরন্তর কঠোর তপস্যা করার পর ঈপ্সিত স্বামীকে কাছে পান। কার্তিকেয় ও গণেশ নামে তাঁদের দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা গঙ্গাও মহাদেবকে পতিত্বে বরণ করেছিলেন।

তাঁর কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী। তিনি স্বয়ং যোগী, কুবের তাঁর ধনরক্ষক। উত্তেজক দ্রব্য পানের পর মহাদেব স্ত্রীর সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্যে রত হন। মতান্তরে বিশ্বধ্বংসের সময় তিনি যে নৃত্য করবেন সেই নৃত্যকেই তাণ্ডব নৃত্য বলা হয়। শ্মশানে মহাদেব সর্পজড়িত মস্তকে ও গলদেশে কঙ্কালমালা ভূষিত অনুচরদের সঙ্গী হয়ে ভ্রমণ করেন। ধ্যানমগ্ন মহাদেবের তৃতীয় নয়নের ওপর অর্ধচন্দ্র, মাথায় জটা, পরিধানে রুধিরাক্ত ব্যাঘ্রচর্ম, উত্তরীয় কৃষ্ণসার মৃগচর্ম, গলদেশে সর্পের উপবীত, হস্তে ডমুর এবং দুর্জনের শাস্তির জন্য মুদ্গর।

মহাদেবের তৃতীয় নেত্র পার্বতী একবার পরিহাসচ্ছলে মহাদেবের দুই চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দেন। ফলে সমস্ত জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং মানুষের সৃষ্ট সবকিছু বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। তখন পৃথিবীকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মহাদেব তৃতীয় চোখ ধারণ করেন। তাঁর এই চোখের জ্যোতিতে মহাদেব হিমালয়কে আবার আগের মতোই সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। প্রলয়কালে তাঁর তৃতীয় নেত্রাগ্নিতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস।

সূত্র: ‘মহাদেব’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪