দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসব। এই উৎসব এখন বৈদিক ও লৌকিক নানা প্রথাপদ্ধতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। দুর্গাপূজার একেকটি রীতি নিয়ে রয়েছে হাজারটা ভাষ্য। বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থে একই দেবীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। আবার বাঙালি হিন্দুরা ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার সঙ্গে নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে একটা নতুন মিথ বা আচার সৃষ্টি করেছেন।
কাজেই দুর্গাপূজা এবং এর বিভিন্ন আচার-নিয়ম পালন সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো মত প্রদান করা অসম্ভব। ‘নানা মুনির নানা মত’ কথাটা সম্ভবত সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য!
বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা সমাগত। দেবী দুর্গাকে নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নানা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। এর মধ্যে নবরাত্রি পালন অন্যতম। আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়। অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নয় রাত্রি ধরে দুর্গার নয়টি শক্তির যে পুজো হয়, তাকেই নবরাত্রি বলে। শরৎকালে এই উত্সব হয় বলে একে শারদ নবরাত্রিও বলা হয়ে থাকে।
‘নবরাত্রি’ কথার অর্থ হলো ‘নয়টি রাত’। ‘নব’ মানে ‘নয়’ এবং ‘রাত্রি’ মানে ‘রাত’। শারদীয়া নবরাত্রির তাৎপর্য নবদুর্গার উৎপত্তি থেকে মহিষাসুরের পরাজয়ের মধ্যে নিহিত। আবার পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে রামচন্দ্র ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গাকে শক্তিরূপে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কার রাজা রাবণকে বধ করার জন্য। শারদ নবরাত্রি দুর্গাশক্তি নয়টি রূপকে উৎসর্গ করে—দুর্গা, ভদ্রকালী, জগদম্বা, অন্নপূর্ণা, সর্বমঙ্গলা, ভৈরবী, চণ্ডিকা, ললিতা, ভবানী ও মুকাম্বিকা। দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপকে নয় দিন ধরে পূজা করা হয়। নবরাত্রির পরের দিনটি বিজয়া দশমী হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
কথিত আছে, মহিষাসুর ভগবান ব্রহ্মার বর পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। ভগবান ব্রহ্মা তাঁর ভক্তিতে খুশি হয়ে তাঁকে অমরত্বের বর প্রদান করেন এবং এই শর্ত দেন যে কেবল একজন নারীই তাঁকে পরাজিত করতে পারবেন। ভগবান ব্রহ্মার এই আশীর্বাদ পেয়ে মহিষাসুর ত্রিলোক তথা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল আক্রমণ করেন। যেহেতু ব্রহ্মার বর অনুযায়ী মহিষাসুর কেবল একজন নারীর কাছেই পরাজিত হতে পারেন, তাই দেবতারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের কাছে মহিষাসুরকে পরাজিত করার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তখন একত্র হয়ে মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য দেবী দুর্গার সৃষ্টি করেন।
একটি দীপ্তিময়ী শক্তিরূপিণী দশ-বাহুর দেবী দুর্গা ত্রিলোককে রক্ষা করার জন্য ১০ দিন ধরে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। দশম দিনে দেবীকে ছলনা করার জন্য মহিষাসুর যখন মহিষের রূপ ধারণ করে, তখন দেবী দুর্গা তাঁর ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে আক্রমণ করেন এবং তাকে বধ করে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করেন। সেই কারণেই নবরাত্রির প্রতিটি দিনে দেবী দুর্গার বিভিন্ন অবতারের পূজা করা হয় এবং নবমীর পরদিন ‘দশেরা’ উৎসব পালিত হয়।
দুর্গার নয়টি শক্তি বা রূপ হচ্ছে শৈল পুত্রী—নবরাত্রির প্রথম দিনে মা শৈল পুত্রীর আরাধনা করা হয়। শৈল পুত্রীর বাহন বৃষ। তাঁর দক্ষিণ হাতে ত্রিশূল আর বাম হস্তে কোমল থাকে। তাই দেবীর অপর নাম শূল-ধরিনি। শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যা হওয়ার জন্য দেবীর এক নাম শৈল পুত্রী। এবং পরজন্মে তিনি দেবাদিদেব শিবকেই পতিরূপে বরণ করেন।
ব্রহ্মচারিণী—দেবী পার্বতীর নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। এখানে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা। ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ তপশ্চারিণী বা তপ আচরণকারী। কথিত আছে যে ‘বেদস্তত্ত্বং তপো ব্রহ্ম’বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হলো ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ। দেবী ব্রহ্মচারিণীর রূপ—জ্যোতিতে পূর্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত। তিনি ডান হাতে রুদ্রাক্ষের জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে থাকেন।
চন্দ্রঘণ্টা—তৃতীয় রাতে পুজো হয় নবদুর্গার তৃতীয় রূপ চন্দ্রঘণ্টার। এখানে মস্তকে অর্ধচন্দ্র থাকে, তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা নামে ডাকা হয়। দেবীর এই স্বরূপ পরম কল্যাণকারী। তাঁর শরীরের রং স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। এই দেবী দশভুজা। দেবীদুর্গার মহিষাসুর বধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত ঘণ্টা যার মধ্যে গজরাজ ঐরাবতের মহাশক্তি নিহিত ছিল, চন্দ্রের চেয়েও সুন্দরী ইনি। তাঁর হাতে কমণ্ডলু, তরোয়াল, গদা, ত্রিশূল, ধনুর্বাণ, পদ্ম, জপমালা থাকে।
কুষ্মাণ্ড—নব রাত্রের চতুর্থ দিনে, অর্থাৎ চতুর্থী তিথিতে মাতৃপ্রাণ ভক্তগণ এই কুষ্মাণ্ডরূপেই আদ্যাশক্তিকে আহ্বান করে থাকেন। দেবী পার্বতী তাঁর চতুর্থ স্বরূপে ‘কুষ্মাণ্ড’ নামে পরিচিতা। উষ্মার অর্থ হলো তাপ। দুর্বিষহ ত্রিতাপ হলো কুষ্মা, যিনি এই ত্রিতাপ নিজের উদরে বা অণ্ডে ধারণ করেন। দেবী সিংহবাহিনী, ত্রিনয়নী ও অষ্টভুজা। আটটি হাতে সুদর্শনচক্র, ধনুর্বাণ, রক্তপদ্ম, কমণ্ডলু, ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হয়। দেবীর বাম হস্তে একটি অমৃতপূর্ণ কলসও রয়েছে। কথিত আছে, দেবী তাঁর এই রূপে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তিনি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে পূজিতা হন। এখানে অমৃত ব্রহ্মের রূপক, দেবী ভগবতী পার্বতী অমৃতপূর্ণ কলস অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের আধার হাতে নিয়ে বসে থাকেন।
স্কন্দমাতা—পঞ্চম রাতে পুজো হয় নবদুর্গার পঞ্চম রূপ স্কন্দমাতার। মা দুর্গার পঞ্চম শক্তি হলো স্কন্দমাতা। স্কন্দের জননী হওয়ায় তাঁকে স্কন্দমাতা বলা হয়। কার্তিকের আরেক নাম স্কন্দ। আর দেবী হলেন দেব সেনাপতি কার্তিকেয় বা স্কন্দের মা। হিন্দুদের বিশ্বাস, সূর্য মণ্ডলের প্রধান দেবতা হওয়ার কারণে, তাঁর সুন্দর চিত্রটি বিশ্বজুড়ে আলোকিত হয়েছে।
কাত্যায়নী—ষষ্ঠ রাতে পুজো হয় নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ কাত্যায়নীর। এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনি। বৈদিক যুগে কাত্যায়ন নামে এক ঋষি ছিলেন। এক পুত্রের পিতা কাত্যায়নের ইচ্ছা হয় একটি কন্যাসন্তান লাভের। দেবী পার্বতীর তপস্যা করে তিনি ইচ্ছা পূর্ণ করেন। তার স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী পার্বতী জন্ম নেন মহাঋষি কাত্যায়নের কন্যা রূপে। তখন তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী। দেবী পার্বতী এই রূপ নিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন।
কালরাত্রি—সপ্তম রাতে পুজো হয় নবদুর্গার সপ্তম রূপ কালরাত্রির। এখানে দেবী কৃষ্ণ বর্ণা। আলুলায়িত কেশে তিনি ধাবিত শত্রুর দিকে। তাঁর কণ্ঠে বিদ্যুতের মালিকা। ত্রিনয়নী দেবীর শ্বাস-প্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা। ভীষণদর্শন দেবীর তিন হাতে অস্ত্র। এক হাতে ভক্তদের প্রতি বরাভয়। এই রূপই পুজো করা হয় কালীকে, তবে এই রূপেও দেবী ভক্তের শুভ করেন। তাই অন্যদিকে তিনি শুভংকরী। দেবীর বাহন গর্দভ।
মহাগৌরী—প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে দেবীর পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। হিমায়লকন্যা ছিলেন গৌর-বর্ণা। শিবের তপস্যা করে রৌদ্রে তিনি কৃষ্ণা হন। মহাদেব যখন গঙ্গাজল দিয়ে তাঁকে স্নান করান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন ফরসা। তাঁর এই রূপের নাম হয় মহাগৌরী। সাদা পোশাক পরিহিতা, চার হাতবিশিষ্টা দেবীর বাহন ষাঁড়। দেবীর এক হাতে রয়েছে শোভিত বরাভয় মুদ্রা। বাকি তিন হাতে থাকে পদ্ম, ত্রিশূল এবং ডমরু।
সিদ্ধিদাত্রী—নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ হলো সিদ্ধিদাত্রী। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’-এ ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টভুজা ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ডে ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টাদশভুজা। ‘সিদ্ধিদাত্রী’ চতুর্ভুজা রূপেও দেখা যায়। সেখানে তিনি শিবের আরাধ্য। সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদী মুদ্রা। তিনি সিদ্ধি দান করেন। অর্থাৎ তাঁর উপাসনায় সংসারে আসে সুখ এবং সমৃদ্ধি। সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকা মূর্তি। দেবী ভগবত পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবী পার্বতীকে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পুজো করেছিলেন ও তার ফলে মহাদেব সব সিদ্ধি লাভ করেন।
একই সঙ্গে এই নয়টি দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নয়টি রং। প্রতিটি রঙের একেকটি আলাদা অর্থও রয়েছে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক কোন রং কী অর্থের সূচক।
নবরাত্রির প্রথম দিন: গাঢ় নীল
নবরাত্রির প্রথম দিনে গাঢ় নীল রঙের পোশাক পরার নিদান দেওয়া হয়। এই রং সমৃদ্ধি ও শান্তির প্রতীক। সেই সুন্দরকে বোঝাতেই ব্যবহার করা হয় নীল রং।
নবরাত্রির দ্বিতীয় দিন: হলুদ
নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে পোশাকের রং থাক হলুদ। হলুদ রঙের পোশাক পরার আসল কারণ এই রং আশাবাদী মানসিকতার সূচক। এ ছাড়া আনন্দের উদ্যাপন করা হয় এই রঙে।
নবরাত্রির তৃতীয় দিন: সবুজ
নবরাত্রির তৃতীয় দিন সবুজ রঙের পোশাক পরতে বলা হয়। সবুজ প্রকৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়, এই রং উন্নতি, সন্তানধারণের ক্ষমতা ও শান্তির প্রতীক।
নবরাত্রির চতুর্থ দিন: ধূসর
নবরাত্রির চতুর্থ দিনে ধূসর রঙের পোশাক পরতে নিদান দেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ ধূসর রং আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত রাখে। আমাদের বিনম্র রাখে।
নবরাত্রির পঞ্চম দিন: কমলা
নবরাত্রির পঞ্চম দিনের কমলা রঙের পোশাক পরার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এই দিন দেবী শক্তির পূজা হয়। তাই কমলা রঙের পোশাকে উষ্ণতা এবং শক্তির পরিচয় ফুটে ওঠে।
নবরাত্রির ষষ্ঠ দিন: সাদা
নবরাত্রি ষষ্ঠ দিন সাদা রঙের পোশাক পরার নিদান দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই রং শান্তি এবং নির্মলতার প্রতীক। এদিন মায়ের আশীর্বাদে মনে শান্তি এবং সুখ আসে।
নবরাত্রির সপ্তম দিন: লাল
নবরাত্রির সপ্তম দিন লাল রঙের পোশাক পরার কথা বলা হয়। এই রং নিজের প্রিয় জিনিসকে প্রকাশ করে, একই সঙ্গে এই রং ভালোবাসার প্রতীক।
নবরাত্রির অষ্টম দিন: নীল
নবরাত্রির অষ্টম দিন নীল রঙের কাপড় পরার কথা বলা হয়। এই রং আকাশের রংকে বোঝায় এবং উদারতার সূচক।
নবরাত্রির নবম দিন: গোলাপি
নবরাত্রির নবম দিন গোলাপি রঙের পোশাক পরার কথা বলা হয়। এই রং সারা বিশ্বের প্রতি নিজের ভালোবাসার প্রকাশ মানুষের সঙ্গে মানুষের সুন্দর সম্পর্কের প্রকাশ।